বর্তমান বাংলাদেশে নারী প্রতিনিয়তই ধাপে ধাপে এগিয়ে যেতে অদম্য আগ্রহ নিয়ে ছুটে চলেছে। এগিয়ে যাচ্ছেও। কালে কালে নারী আপন কর্মদক্ষতায় বিভিন্ন পেশায় যুক্ত করার পাশাপাশি আইন-অঙ্গনকেও সমৃদ্ধ করেছে। কিন্তু আইন মাধ্যমে লেখাপড়া যতটা সহজ, নারীর পক্ষে এদেশে টিকে থাকা ঠিক ততটাই কঠিন, বাংলাদেশের আর সকল মাধ্যমের মতোই। আইন বিষয়ে লেখাপড়া শেষে তিন ধাপ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও নারী পাচ্ছে না তার শ্রম, ঘাম, রক্তের মূল্যায়ন। দুঃখজনক হলেও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, ভালো দক্ষতা থাকার পরেও অনেক মক্কেল পুরুষ ও বয়ষ্কদের প্রাধান্য দেয় এক্ষেত্রে অনেকাংশে দায়ী। তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে পেশাদারীত্বে অসদাচরণ, বিভিন্ন স্তরে অবৈধ অর্থ প্রদানে বাধ্য করতে চাওয়ার অভিপ্রায় নারীদের সাবলীল কর্মপরিবেশ কলুষিত করে চলেছে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী হিসেবে দাবি প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া অনেকেই ‘জ্যেষ্ঠ আইনজীবী’র সংজ্ঞাটিই জানেন না। নিজেদের ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত তরুণীদের প্রাধান্য দিতে যেমন অনেক পুরুষ আইনজীবী পছন্দ করেন তেমনি অনেক নারী আইনজীবীও তার তুলনায় তরুণ শিক্ষানবিশদের দিয়ে কাজ করাতে পছন্দ করছেন। এর ফলে অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন নারীর জন্যে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ প্রতিকূল হয়ে উঠছে এবং তাঁরা কর্মস্পৃহা হারাচ্ছেন।
জুনিয়রশিপ করা সনদপ্রাপ্ত আইনজীবী মেয়েরা অনায়াসে জীবনের প্রয়োজনে সহকর্মী আইনজীবীর ফাইল, ব্যাগ, গাউন বহন করেও যোগ্যতার মাপকাঠিতে পারিশ্রমিক পাচ্ছেন না। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে নবীন আইনজীবীর মক্কেলদের বিপরীতে তরুণী আইনজীবীদের অবমূল্যায়ন, তিরষ্কার, তুচ্ছার্থক বাক্য ব্যবহার ও আক্রমণ। এমনকি মামলার ফাইল হাতিয়ে নেয়ার প্রবণতাও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়। ফলে পেশাদারীত্বের এই জায়গাটিতে নারী আইনজীবীরা সকলের অগোচরেই অসহায় হয়ে পড়েন।
নারীদের অগ্রগতিতে পুরুষে নয়, ক্ষেত্রবিশেষে নারীও পুরুষতান্ত্রিকতার ধারক ও বাহক হয়ে ওঠেন। এ কারণে নারীপুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টা তাই বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। পেশায় পদমর্যাদা স্বীকৃত না থাকায় নারী আইনজীবীদের সুকৌশলে পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে।
রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সে রাষ্ট্রের আইনের শাসন নিরবচ্ছিন্ন প্রয়োগের মাধ্যমে। এই আইন ও তার শাসনকে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রতিষ্ঠায় সামনের সারিতে যারা কাজ করেন, সেই সামনের সারিতে কাজ করা মানুষগুলোর পেশাটির পদপরিচয়— ‘আইনজীবী।’ অথচ বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, নারী আইনজীবীদের জন্যে মাতৃত্বকালীন সুযোগ সুবিধা নেই! অন্যদিকে নারী আইনজীবীদের পেশাদারিত্বে যৌন হয়রানীর আশঙ্কার প্রসঙ্গ টেনে কর্মক্ষেত্রে নিজেদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবার ঝুঁকি, পরিবারের অসহযোগীতা ইত্যাদি প্রতিবন্ধকতাগুলো পেশাদারিত্ব তৈরি করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যার ফলে নারী আইনজীবীদের কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ নারীর জন্যে কঠিন হয়ে উঠেছে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারিসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের চাহিদা পূরণের অর্থ তথা বহুলাংশে পেশকার, সেরেস্তাদার, উমেদার, জারীকারক, স্টেনো, জিআরওপিপি, পিয়ন অনেক নারী আইনজীবীরা মক্কেল থেকে মিথ্যার ফুলঝুড়ি দিয়ে বাগাড়ম্বর হয়ে আদায়ে সচেষ্ট না হওয়ায় পেশাদারীত্ব হারাচ্ছে। এরপরও নারী পুরুষের সমন্বিত প্রচেষ্টাতেই আজও অনেকদূর এগিয়েছে আমাদের দেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সজাগ দৃষ্টিভঙ্গি, নারীর ক্ষমতায়নকে অনেক দূর এগিয়ে নিলেও পাড়ি দিতে হবে আরো অনেক পথ। ‘না পারি’ থেকে নারি- তা থেকে নারী, এটা ঠিক বলেই আজকাল নারীর পক্ষে অন্যদের ওপর বিশ্বাস স্থাপনের সুযোগ তেমন আর নেই।
পারিবারিক, রাষ্ট্রীয় সামাজিক, অর্থনৈতিক, আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রেই নারীরা অন্যদেশের তুলনায় বাংলাদেশে অনেকদূর এগিয়েছে।
কায়িক শ্রমের পাশাপাশি মেধা ও মননে উন্নয়নকাজে নারীর অংশগ্রহণ দেশকে এগিয়ে নিতে পারে বহুলাংশে। নারীবান্ধব সমাজ গড়ে তুলতে নারী পুরুষের সমান ভূমিকা পালন অত্যাবশ্যক। রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে একা কোনো কিছু বদলে দেয়া সম্ভব নয় যদি না সকলের বদলানোর মানসিকতা থাকে। প্রয়োজন আমাদের সকলের অংশগ্রহণ।
সরকারি, আধা সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আইন পেশা সংশ্লিষ্ট চাকরিতে নারীদের অংশগ্রহণ দেশকে এগিয়ে নিতে পারে বহুদূর।
ইকুইটি ও ইকুয়ালিটি-সমদর্শিতা ও সাম্যতা, এই দুইয়ের অর্থ কেবল বুঝলে চলবে না, এর তাৎপর্য উপলব্ধি করতে হবে। তেমনি অন্যদেরও জানাতে হবে। জেন্ডার বৈষম্য ভেঙে সামর্থ্য অনুযায়ী সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টাই আইন অঙ্গনে ‘নারীর অধিকার রক্ষাকবজ’ হিসেবে মহীরুহ হবে।
অদূর ভবিষ্যতে মানচিত্র ও পতাকার মর্যাদা সমুন্নত রাখতে নারীর অংশগ্রহণে নিশ্চিতের এ লড়াইয়ে আমাদের বিজয়ী হতেই হবে। আইন অঙ্গনে সে অধিকারের বীজ বপন করে দেশের ভাগ্য বদলানো এখন সময়ের দাবি। এ দাবি পূরণ করা গেলেই প্রতিষ্ঠা করা যাবে নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণমুক্ত একটি সমাজব্যবস্থা।
সর্বোপরি মানুষ যদি সত্যিই সবার ওপরে সত্য হয়, তবে মানুষের মাঝে এ বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা ও স্থাপনের বিকল্প নেই। আর বিশ্বাসের এই প্রতিষ্ঠা ও স্থাপনে যেটি জরুরি, সেটি আস্থা। মানুষের ওপর মানুষের আস্থা। আস্থা পুরুষের ওপর নারীর। তেমনি নারীর ওপর পুরুষের।
সকলকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা দ্বারাই অপার সম্ভাবনাময়ী সোনার বাংলাকে ক্ষুধা, দারিদ্র্য, নিপিড়ন, নির্যাতন মুক্ত করা সম্ভব। ❐
লেখক: আইনজীবী