অনুলিখন: মাইশা সুফি
নিউ ইয়র্ক প্রবাসী যারা তাঁদের সঙ্গে স্বদেশ থেকে লেখাপড়া করতে যাওয়া তরুণদের হয়ত একটা যোগাযোগ থাকে। আবার থাকেও না। স্বজনরা তাঁদের খবর কেউ জানতেও পারেন না। ওই তরুণরাও ব্যস্ত ভবিষ্যৎ গড়তে। এইই নিয়ম। আগামীতে শক্ত হয়ে দাঁড়াবার মাটিটি এখনই তৈরি করে ফেলতে হবে। ফলে ব্যস্ততাটাই স্বাভাবিকতা। ফলে লেখাপড়া শেষ করে পেশাগত জীবনে হাঁটতে শুরু করবার পরও অনেকে বুঝতেও পারেন না কতটা সময় পেরিয়ে গেছে। তারপর হয়ত জীবনের কোনো একটা সময়ে কোনো এক উপলক্ষ্যে আচমকা হিসেব কষে বিস্ময় বলে দেন।
কিন্তু কেউ কেউ এই তারুণ্যেই ঝলসে ওঠেন। এরাও শক্ত হয়ে দাঁড়াবার মতো মাটিটা নির্মাণ করতে চান, তবে সে চাওয়াকে তারা যান্ত্রিক করে প্রতিষ্ঠা করতে রাজি নন তারা। তারা বিশ্বাস করেন, কাজের ক্ষেত্রটি শুধুই পেশাগত দায়িত্ব পালন নয়, ভালো লাগাটাও গুরুত্বপূর্ণ। এদেরই একজন ফৌজিয়া জে চৌধুরী। তিনি বাঙালি-আমেরিকান।
ফৌজিয়া জে চৌধুরী নিউ ইয়র্কে গেছেন সবে চার বছর পেরুলো। গেছেন পরিবারের সঙ্গেই। পরিবারের সকলে। এখন নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পোস্ট গ্রাজুয়েট করছেন। এরই মধ্যে নিউ ইয়র্কভিত্তিক প্রতিষ্ঠান শাহ গ্রুপের সহ প্রতিষ্ঠাতা তিনি। এছাড়া শাহ ফাউন্ডেশন ও নিউ ইয়র্কভিত্তিক বাংলা টেলিভিশন চ্যানেল বাংলা চ্যানেলের ভাইস প্রেসিডেন্টও তিনি।
সম্প্রতি ফৌজিয়া জে. চৌধুরীর সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে মিলিত হয়েছিলেন অনুস্বরের নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধি। আলোচনায় ফৌজিয়া জে. চৌধুরী অকপটে বলেছেন অনেক কথা।
ফৌজিয়া জে. চৌধুরীরা ভারতের রাজধানী দিল্লিতে থেকেছেন দীর্ঘদিন। নিউ ইয়র্ক গিয়েছেন দিল্লি থেকেই। সে কারণে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সঙ্গে প্রাচ্যর সংস্কৃতির যে ফারাকটা আছে, সেটি তাকে তেমনভাবে পোহাতে হয় নি বলে মনে করেন তিনি। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রটি সেখানে আসলেই ভিন্নরকম। কেননা ফুলটাইম কাজ আর তার সঙ্গে ফুলটাইম লেখাপড়া। এখানে যার কাজ তাকেই করতে হবে, সবকিছুই। আর কেউ কাজটা করে দেবে না। এটাই আমেরিকার জীবন যাপনে, কাজের ধরণ, বলছিলেন ফৌজিয়া।
দিল্লি থেকে আমেরিকা- প্রাচ্য থেকে পাশ্চাত্যর পার্থক্যটা মূলত সাংস্কৃতিক। ফৌজিয়ার মতে এর কঠিন অংশটি হলো দু সংস্কৃতির মধ্যে ভারসাম্য খুঁজে পাওয়া। দেখবার বিষয় হলো, আপনি আমেরিকানদের সঙ্গে মিশতে পারার মতো যথেষ্ট আমেরিকান হতে পেরেছেন কিনা, আবার একইসঙ্গে নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধারণ করবার মতো যথেষ্ট সংস্কৃতিবান কিনা। সেটা বাঙালি, ভারতীয় কিংবা পাকিস্তানি যে সংস্কৃতির মানুষই আপনি হোন না কেন। তিনি মনে করেন নিজস্ব সংস্কৃতিকে ধারণ করেই দু সংস্কৃতির মধ্যকার ভারসাম্যতার পদ্ধতিটা খুঁজে নিতে হয়। নিজের তো বটেই, অন্যদের প্রতিও পোশাক, খাদ্য, ভাষা, ঐতিহ্য সবকিছুতে একটা উদারনৈতিক মানসিকতা ধারণ করতে হবে। কেননা সকলেরই নিজস্ব ও ভিন্ন ভিন্ন ঐতিহ্য, ভাষা, খাদ্য রুচি রয়েছে।
ফৌজিয়া জানান, নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত পৌঁছতে তাকে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছে। আমাকে নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে পড়তেই হবে এই ভাবনাটি সবসময়ই তার মাথায় ঘুরত। কিন্তু ফৌজিয়া জানতেন না সেটা তিনি কিভাবে সম্ভব করে তুলবেন। তিনি বলেন, কঠোর পরিশ্রম, স্থির দৃঢ়তা আর অধ্যাবসায় এক্ষেত্রে খুব জরুরি। আর সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে নিজের জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণে ভীষণভাবে আগ্রহী হওয়া। নইলে আপনি যেখানে পৌঁছুতে চান, কখনোই সেখানে পৌঁছুনো যাবে না। চার বছর আগে নিউ ইয়র্কে গিয়ে শুরুতে স্থানীয় কমিউনিটি কলেজেই লেখাপড়া শুরু করেন। এরপর লক্ষ্য নির্ধারণ করলেন তিনি আসলে কি করতে চান। তারপর একটু একটু করে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হতে লাগলেন। এভাবেই ফৌজিয়া আজ বর্তমানের অবস্থানে।
আমেরিকায় যারা নতুন আসছেন তাদের জন্য ফৌজিয়ার পরামর্শ হলো, কমিউনিটি কলেজ থেকে এনরোলড করা। দু বছর সেখানে লেখাপড়া করাটা ভীষণ সহজ। অন্য দেশ থেকে আসবার পরে এখানকার ছাঁচে পরিণত হতে খুব কাজে লাগে। কাজের চাপও কম থাকে। দু বছরের কলেজ শেষে গ্যাজুয়েট করার পরে একটা চার বছরের কলেজে বদলি হয়ে যেতে হবে। দু বছরে গ্রাজুয়েশনও হয়ে যাবে। পরবর্তীতে আরও পড়তে চাইলে নতুন ধাপ শুরু। তাছাড়া শুরুতেই কমিউনিটি কলেজ না গিয়ে বড় কোনো কলেজ যাওয়া মানে প্রচুর কাজের চাপ। তাল মিলিয়ে চলাতেও অসুবিধা। কমিউনিটি কলেজের মতো করে আস্তে ধীরে নতুন পরিবেশে সইয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা থাকবে না। এটা ভীষণ একটা মানসিক চাপ তৈরি করে। আর অর্থনৈতিক চাপ তো রয়েছেই।
ফৌজিয়াকে স্কুলের খরচ মেটাতে ফুলটাইম কাজ করতে হয়েছে। কাজের ক্ষেত্রটিতে ছোটবড় বলে কিছু নেই। শুধু মাথায় রাখতে হবে, আমি কাজ করলে টাকা পাব এবং সেটা আমার স্কুলের খরচ। আমেরিকায় সবাই কঠোর পরিশ্রম করে। আর সব কাজই সম্মানের। অন্য দেশ থেকে আসেন যারা, তাদের ক্ষেত্রে টাকা একটা বিশাল ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ফলে একে উপেক্ষা করার উপায় নেই। কমিউনিটি কলেজে এটা তেমন সমস্যা নয়। কলেজ সব ধরনের সহযোগিতা করতে সবসময়ই তৈরি থাকে।
ফৌজিয়া মনে করেন, জীবনে ভারসাম্যতা বজায় রেখে চলতে হলে সময়ানুবর্তিতার দরকার। সময়ের মূল্যায়ন করতে হবে। এটা কেবল নিজের সময়ের ক্ষেত্রে এবং অন্যদের সময়ের ক্ষেত্রেও। সময়ের এই ভারসাম্যতা বজায় রাখতে পারার কারণেই তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি শাহ গ্রুপের সহ-প্রতিষ্ঠাতার, বাংলা চ্যানেল আর এবং শাহ ফাউন্ডেশনের ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্বটি নিরলস পালন করে চলেছেন।
ফৌজিয়া জে. চৌধুরী জানান, ভবিষ্যতে তিনি পেশা হিসেবে মানব সেবাকে গ্রহণ করতে চান। ভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রবাসীদের পরামর্শ কিংবা বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করবার জন্যে শাহ ফাউন্ডেশন চমৎকার একটি প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করবে। বাংলা চ্যানেল টেলিভিশন এখনো পরিকাঠামোগত কোনো পরিকল্পনা করেন নি যদিও, কিন্তু কিছু করবার প্রচেষ্টাটি অব্যাহত রয়েছে তার। ইতোমধ্যে শাহ ফাউন্ডেশন করোনা ভাইরাসের সংকটে নিউ ইয়র্কয়ের বাঙালি কমিউনিটি, ভারত ও বাংলাদেশের অনেক মানুষকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করতে চেষ্টা করেছে। ফৌজিয়া জানান, নিজেদের প্রতিষ্ঠানটি তাদের পরিবারেরই অংশ। প্রতিষ্ঠানের সকলেই পরিবারের সদস্য। পরিবারের সদস্যরা সবসময়ই প্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটিকে সাহায্য করতে চান।
মনোবিজ্ঞানের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে ফৌজিয়া মনে করেন, করোনা মহামারীর উদ্বুদ্ধ পরিস্থিতিতে মানুষের ওপর যে মানসিক চাপ তৈরি হয়েছে, তা থেকে মুক্তি পেতে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। অভ্যন্তরের নিকৃষ্টর সঙ্গে লড়াই করে উৎকৃষ্টকে বের করে আনতে হবে। তার মতে, আমরা কেবল কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি। নিজেদেরকে যথেষ্ট সময় দেই নি। এখনকার এ সময়টা নিজের জন্যে। সময়টা নিজের ব্যক্তিসত্ত্বাকে উন্নত করবার একটা সুযোগ। ভুলে গেলে চলবে না, একজন উন্নত মানুষই উন্নত কিছু দিতে সক্ষম।
ফৌজিয়া বলেন, মহামারীর কারণে লকডাউনের ফলে তরুণদের পক্ষে ঘরে বসে থাকাটা একটু কঠিন। সেক্ষত্রে তারা নতুন নতুন কাজে দক্ষতা অর্জন করতে পারে, যেমন ইন্টারনেট শিক্ষা কিংবা বিভিন্ন কোর্সের মাধ্যমে নিজেকে ব্যস্ত রেখে ভবিষ্যতের জন্যে সময়টাকে কাজে লাগাতে পারে।
ভারত, বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যর বিষয়টাকে একেবারেই অবহেলিত রাখা হয়েছে। ফৌজিয়া বেড়ে উঠেছেন ভারতের রাজধানী দিল্লিতে। কিন্তু কখনোই মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কিছু শোনেন নি। অথচ এটিই সমস্যার মূল। সমস্যার মূলে হাত দিতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে। আর এই পরিবর্তন আনতে হলে আমাদেরকে আমাদের কথাগুলো বলতে হবে। আর পরিবর্তনের শুরুটা কিন্তু যার যার নিজের ঘর থেকেই শুরু করতে হয়।