অতীতকে কিভাবে স্মরণ করা উচিত? অতীত আমাদের কখন ভুলে যাওয়া উচিত? এগুলো সহজ প্রশ্ন নয়। অতীতের কঠিন অংশ স্বীকার করাও সবসময় সহজ নয়। ১৫ আগস্ট ১২৮১ জাপান আক্রমণ করতে গিয়ে কুবলাই খানের নৌবহর ঝড়ে পতিত হয়ে ধ্বংস হয়। ইতিহাসে এ ঘটনা ডিভাইন উইন্ড বা দৈব বাতাস বলে পরিচিত। এই দৈব বাতাস হাজার বছর ধরে প্রবাহিত হয়েছে। এই বাতাসেই অন্য এক ১৫ আগস্টে জাপান আত্মসমর্পন করেছে। বৃটিশ সূর্য অস্তমিত হয়েছে। জন্ম হয়েছে নিউ ওয়ার্ল্ড ওর্ডার বা নতুন বিশ্বনীতি। এই দিন আধুনিক বিশ্ব বিভক্ত হয়ে আনবিক বিশ্বে পরিণত হয়েছিল। ১৫ আগস্টের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পূর্ববর্তী পৃথিবী আর পরবর্তী পৃথিবী এক নয়। ১৫ আগস্ট বদলে দিয়েছিল পৃথিবী অর্থনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান, প্রযুক্তিসহ সমপূর্ণ বিশ্ব সমাজ ব্যবস্থা।
কথা হলো, কেন ১৫ আগস্ট বিশ্ব ইতিহাসে এত গুরুত্বপূর্ণ? ১৫ আগস্টকে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন কেন বেছে নিয়েছিলেন? কারণ একটাই। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণের দ্বিতীয় বার্ষিকী ১৫ আগস্ট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের সম্রাট হিরোহিতো ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট আত্মসমর্পণ করেন। সেসময় মাউন্ট ব্যাটেন ছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের প্রধান সেনাপতি। তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের সঙ্গে বসে শুনেছিলেন ওই ঘোষণা। তখনই তার মাথায় ১৫ আগস্ট গেঁথে গিয়েছিল। ফলে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাস করার সময় ওই আইনে ১৫ আগস্টকেই ধরা হয় ব্রিটিশ ভারতের শেষ দিন। সেখান থেকেই বিশ্ব ইতিহাসের নতুন পট পরিবর্তনের সূচনাটি হয়।
১৫ আগস্টের বিভিন্ন ঘটনারাজির মধ্যে রয়েছে মহা শক্তিধর ইউরোপীয় যুগের অবসান, মার্কিন পরাশক্তির উত্থান, সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রসার ও পরাশক্তি মর্যাদায় উত্থান, পুর্ব ও পশ্চিমের শীতল যুদ্ধের উত্থান, পারমাণবিক যুগের সূচনা, এশিয়া ও আফ্রিকার জাতীয়তাবাদ এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্থান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বিশ্বে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার এক নতুন প্রচেষ্টা। সমগ্র বিশ্ব দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে মার্কিন ব্লক ও সোভিয়েত ব্লকে পরিণত হয়।
১৫ আগস্ট বছরের আর দিনগুলোর মতো সাধারণ কোনো তারিখ নয়। এই তারিখটি একটি বিশ্বযুদ্ধকে থামিয়ে দিয়েছিল। ওই বিশ্বযুদ্ধের প্রায় ৮ কোটি মানুষের মৃত্যু হয়। পুরো ইউরোপ বিরানভূমিতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। গৃহহীন হয়ে পথে নেমেছিল প্রায় ৬০ কোটি মানুষ। খাদ্যহীনতা, অপুষ্টির বিভিন্ন ব্যাধিতে মারা যায় আরো কয়েক মিলিয়ন মানুষ। বিশ্ব অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। গণতান্ত্রিক ইউরোপীয় শিল্প অবকাঠামোর বেশিরভাগ অংশই ধ্বংস হয়ে যায়। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নও ক্ষতিগ্রস্থ হয়। একইসঙ্গে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় শান্তি, সুরক্ষা ও সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে একটি নতুন আন্তর্জাতিক নীতি ও আদর্শের জন্ম হয়। যুদ্ধ শেষে মিত্রশক্তিগুলো সন্মিলিতভাবে সংঘাত রোধে ব্যর্থ হওয়া লিগ অফ ন্যাশনের চেয়ে শক্তিশালী একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করতে সম্মত হয়। তারই ফলশ্রুতিতে জাতিসংঘ গঠন ও শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীর মানুষ মুক্তি পেতে চেয়েছে। নিশ্চয়তা পেতে চেয়েছে যুদ্ধের নৃশংসতা ও ধ্বংসাত্মক ঘটনাটি আর যেন কখনও সংঘটিত হতে না পারে। চেয়েছে পরিকল্পিত অংশীদারিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান এবং অংশীদারিত্বের ব্যবস্থার মাধ্যমে বৈশ্বিক স্বার্থ রক্ষার নতুন বিশ্ব ব্যবস্থাপনা।
১৫ আগস্টের তাত্ক্ষণিক প্রভাব ছিল ইউরোপ ও জাপান বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া, বিশ্ব পরিচালক পদে শীতল যুদ্ধ লিপ্ত আমেরিকার একক পরাশক্তিতে পরিণত হওয়া। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ব ইউরোপ দখল করে নেয়া। ঘটনাগুলোর সুদূর প্রসারী প্রভাব লক্ষ্য করলে বোঝা যাবে কিভাবে শক্তিশালী দেশগুলো বিশ্বে এককভাবে প্রভাবশালী অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক ভূমিকা পালনের সুযোগ পেয়েছে। মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণা দিয়ে মৌলিক মানবাধিকার এবং স্বাধীনতা ক্ষুণ করার শক্তি পুঞ্জিভূত করার সুযোগ পেয়েছে। জেনেভা কনভেনশনের নামে করা যুদ্ধবন্দীদের প্রতি মানবিক আচরণ পরিচালনা করার জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি গণতন্ত্রের পতাকাবাহীরা কিভাবে ভূলুণ্ঠিত করেছে।
১৫ আগস্ট পরবর্তী ইউরোপ দু ভাগে ভাগ হয়ে যায়। পশ্চিম ইউরোপে পুঁজিবাদ অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্র বিকশিত হয়। এই দুই মতাদর্শকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে দুটি সামরিক জোট ন্যাটো ও ওয়ারশ। সাম্রাজ্যবাদীদের প্রাক্তন সাম্রাজ্য শক্তিগুলোর বিশাল অঞ্চলগুলোতে আর্থিক এবং সামরিক ক্ষমতা বিনষ্ট হয়। যেটি পরবর্তীতে সমগ্র এশিয়া আফ্রিকা জুড়ে ইউরোপীয় বাহিনীর পরাজয় ও ইউরোপীয় শক্তিকে ধ্বংস করতে ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্টে ভারত এবং পাকিস্তান নামে দুটি নতুন দেশ তৈরির ফলে বার্মা, শ্রীলঙ্কা এবং মালয়েশিয়া স্বাধীনতার রাস্তা অনুসরণ করেছিল। ১৫ আগস্ট যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা ইন্দোনেশিয়ায় ডাচ সাম্রাজ্য এর উপনিবেশের পতন ও স্বাধীনতার প্রক্রিয়াটিকে আরও ত্বরান্বিত করে। সর্বশেষে ১৯৪৯ সালে, ডাচদের থেকে ইন্দোনেশিয়ার সার্বভৌমত্ব লাভ করে। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সের উপনিবেশগুলোতে সাম্রাজ্যবিরোধী আন্দোলন জেগে ওঠে এবং এর ফলে ফ্রান্স অচিরেই তার বেশির ভাগ উপনিবেশ হারায়। ভিয়েতনামের সেনাবাহিনীর হাতে ১৯৫৪ সালে অপমানজনকভাবে পরাজিত হয়। ১৯৫০ এবং ১৯৬০ এর দশকের গোড়ার দিকে ইউরোপীয়দের আফ্রিকান সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। বলা যায়, ১৫ আগস্ট ইউরোপীয় উপনিবেশিকতার অবসান ঘটায়। বিশেষ করে আফ্রিকা ও এশিয়ায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা হয়। আফ্রিকা থেকে এশিয়া পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে নিয়ন্ত্রণকারী ইউরোপীয় সাম্রাজ্যগুলো ক্রমবর্ধমান জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মুখে অদৃশ্য হয়ে গেল। এ সময় পুঁজিবাদী শক্তিগুলো আন্তর্জাতিক মুদ্রা ও বাণিজ্য সমপর্কিত জেনারেল এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সংস্থাগুলো খোলা বাজার অর্থনীতি পলিসিকে সহায়তা করতে ধীরে ধীরে মুক্ত অর্থনীতিভিত্তিক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করতে থাকে। শুরু হলো পুঁজিবাদী অগ্রাসন। পৃথিবীতে রাজনৈতিক সীমানাকে পাল্টে দিয়ে তৈরি করা হয় অর্থনৈতিক সীমানা। সীমানা দখলের যুদ্ধের পরিবর্তে শুরু হয় বাজার দখলের যুদ্ধ।
শরণার্থী সমস্যায় জর্জরিত হয়ে উঠল বেশিরভাগ দেশ। নতুন নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চলে ভিড় জমায় যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোর মানুষেরা। যাদের মাধ্যমে নতুন নতুন আবিষ্কার ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। রেডিও নেভিগেশন, মেডিসিন, সিন্থেটিক রাবার এবং তেল, রাডার, জেট ইঞ্জিন, পারমাণবিক শক্তি ও কমিপউটারসহ মহাকাশ ভ্রমণ – জ্ঞান বিজ্ঞানের কোনো শাখাই বাদ যায় নি। এই আবিষ্কারগুলোর সুবিধা ভোগ করতে হয়ত অনেক বেশি সময় লেগে যেত। ১৫ আগস্ট সেটাকে ত্বরান্বিত করেছে। আর এই তালিকাটি এখনও দীর্ঘ হয়েই চলেছে। সেটারই আরেকটি ফলাফল গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বয়িক উষ্ণতা।
১৫ আগস্টের একটি ঘোষণার ফলেই অনেক দেশে প্রতিকূল বর্ণবাদী পরিবেশে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। নারীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ ও ইটালি-ফ্রান্সের মতো দেশগুলোতে ভোটাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছিল। ইউরোপ ও এশিয়ার মানুষের মধ্যে জন্মগত বিভাজন পুরোপুরি দূর না করা হলেও অবস্থার পরিবর্তন হতে শুরু করেছিল। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক মতাদর্শ – ফ্যাসিবাদী, রক্ষণশীল এমনকি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও – চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে। ইউরোপে হাজার হাজার ইহুদি শরণার্থীদের নিয়ে একটি নতুন রাষ্ট্র গঠনের চক্রান্তের ফলে মুসলিম বিশ্বের মাঝে অশান্তির সূচনা করে হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইজরায়েলের মতো ক্ষত নির্মাণের ফলে মুসলিম ও অমুসলিমদের মাঝে একটি স্থায়ী সমস্যার জন্ম দিয়েছে। এছাড়া পারিবারিক বন্ধন বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই ভেঙ্গে পড়েছে। কোটি কোটি নারী বিধবা হয়েছে, অনাথ হয়েছে অসংখ্য শিশু। একান্নবর্তী পরিবার থেকে একক পবিবারে রূপান্তরিত হয়েছে। নারী স্বাধীনতা ও ভোটাধিকারের ফলে নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও জ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন দিকে অবদান রাখছেন। বৃটিশ থেকে মুক্ত হয়ে বাঙালি ও ভারতীয়রা ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশগুলোতে মাইগ্রেট করেছে। বিভিন্ন দেশে বাংলা-ভারতীয়-ইউরোপীয় সংস্কৃতি মিলে একটি মিশ্র সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। বিয়ে বিচ্ছেদের হার বেড়েছে। অনেক পরিবারকে সামঞ্জস্যতা রক্ষা করতে লড়াই করতে হচ্ছে। ১৫ আগস্টের পরিবর্তনের ফলেই নতুন পৃথিবীর নতুন সমাজ গড়ে উঠেছে। ভারত ভাগের পর পরই দেখা যায় পাঞ্জাব ও বঙ্গ প্রদেশের মধ্যে ভয়াবহ দাঙ্গা যা ভারত-পাকিস্তান সমপর্ককে আরও নাজুক করে দেয়। জন্ম দেয় দীর্ঘমেয়াদী অবিশ্বাস। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথ বন্ধ হয়ে যায়। ভারতে সর্ববৃহত্ দুই খাদ্য গুদাম ও রাজনৈতিক শক্তি নষ্ট করে দেয়ার জন্য বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্ত করা হলো। ভারত যেন আর মাথা তুলে দাড়াতে না পারে সেজন্য বৃটিশ কুচক্র সফলভাবে ভারতকে টুকরো টুকরো করে ফেলল। ভাষা ও ধর্মের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সাম্প্রদায়িক সত্তার শেকড় হাজার বছরের অবিভক্ত ভারতীয় জনগোষ্ঠীর ভেতর স্থায়ী ক্ষত তৈরি করে দিল। প্রদেশ ভাগ করার ফলে এসব অঞ্চলের মানুষের ভেতর আপনাপন জাতিসত্তা ভেঙে যাওয়ার ক্ষোভ দানা বাঁধল। যার ফলে এ অঞ্চলের মানুষ অন্য জাতিসত্তার শাসনকে সহজে মেনে নিতে পারে নি। এ কারণেই উত্থান হয় বাংলাদেশের মতো স্বাধীন দেশটির। আর এরই ইমপ্যাক্ট ১৫ আগস্ট ১৯৭৫।
১৫ আগস্ট ১৯৪৭ ঘোষণার ফলে সৃষ্ট নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় সমাজতন্ত্রের গতি রোধ করল। নতুন শক্তির উত্থান প্রতিরোধে নেয়া হয় পুঁজিবাদী নতুন নতুন মহাপরিকল্পনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার বিজয় যেন সমাজতন্ত্রের বিজয় হিসেবে মূল্যায়িত না হয় এবং সমাজতন্ত্র যেন বিশ্বে স্থায়ী না হতে পারে সেজন্য গণতন্ত্রের মোড়কে বিষ ছড়িয়ে দেয়া হলো পুরো বিশ্বজুড়ে। বাংলা ও ভারত জুড়ে বৃটিশ বিরোধী অন্দোলনের ফলে সমাজতন্ত্র ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তাকে গলা টিপে হত্যা করতেই গণতন্ত্রের মোড়কে রাজতন্ত্রের ধারকেরা নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার নীতিমালা বানিয়ে ফেলল। সমগ্র বিশ্বে গণতন্ত্রের এজেন্ট হিসেবে ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে সমর্থন করতে লাগল। আসলে লক্ষ্যটি ছিল রাশিয়ার সমাজতন্ত্র যেন ভারতে প্রতিষ্ঠা না পায়। সেকারণেই সাতচল্লিশে ভারতকে স্বাধীনতা ‘দান’ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নীতি গ্রহণ করা হয়। এরপর হিন্দু-মুসলিম হতাশা আর বঞ্চনাকে ব্যবহার করে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে আলাদা রাষ্ট্রের মতকে সমর্থন করে ভারতকে ভাগ করার জন্য উদ্যোগী হয়। উদ্দেশ্যটি ওই সমাজতন্ত্রকে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে না দেয়া। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন ১৯৪৭ পাস বা ১৫ আগস্ট ঘোষণা দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ ভারতীয় উপমহাদেশটাকে ভেঙে কয়েকটা টুকরো করে ফেলল। এর সঙ্গে বদলে গেল পৃথিবীর ইতিহাসটাও। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিকসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলল। পরবর্তীতে দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক রাজনীতিতে কৌশলগত পরিবর্তনের ধারণা আত্মপ্রকাশ করল। এরই ফলে পরিবর্তিত পৃথিবীতে নতুন দুটি পারমাণবিক শক্তি অঞ্চল ভারত ও পাকিস্তান জন্ম নিতে পেরেছে। বড় দেশ হিসাবে ভারত বিশ্বের অন্যতম একটি অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রায় ৬০ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে। শহরগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। পরিবারগুলো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। মানুষ অভূতপূর্ব কষ্ট স্বীকার করেছে। তবে এটা আরও একটি পরিবর্তনকেও ত্বরান্বিত করেছিল। ১৫ আগস্টের প্রতিক্রিয়ার ফলে বিশ্বজুড়ে তৈরি হয়েছে গ্লোবাল ভিলেজ। বিভক্ত বিশ্বের মানুষগুলো প্রযুক্তির অবিভক্ত করণের প্রক্রিয়ায় বিশ্বের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তের মানুষের সঙ্গে ভার্চুয়াল যোগাযোগ শুরু করেছে। বিভিন্ন দেশে অবস্থান করা মানুষের মধ্যে চিন্তাভাবনা, অভিজ্ঞতা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি ইত্যাদির বিনিময় হচ্ছে। আজকে পুরো বিশ্বটাই একটা ভার্চুয়াল গ্রাম। আমরা ডাকছি ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ বা বিশ্বগ্রাম নামে। শব্দকোষে প্রবেশ করেছে বিভিন্ন নতুন নতুন শব্দ। নািসরা ইউরোপের মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে হত্যা করেছিল। সে ঘটনাকে বিভিন্ন ভাষায় ‘গণহত্যা’ নামে অভিহিত করে নতুন শব্দ যুক্ত করেছিল। যখন যুদ্ধ থেকে বাঁচতে লক্ষ লক্ষ লোক তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়, অভিধানে তখন একটি নতুন শব্দ যুক্ত হয়েছিল, ডিপি বা ‘বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি।’ রাজনৈতিকভাবে দুর্দান্তপ্রভাবের ফলে দুটি শক্তি এতই দুর্দান্ত হয়ে ওঠে যে তাদের জন্য নতুন শব্দ তৈরি করতে হলো- ‘পরাশক্তি।’
অভিবাসন গড়েছে নতুন পৃথিবী। ১৫ আগস্টের একটি ঘোষণার সুদূরপ্রসারী প্রভাবে বর্তমান পৃথিবীতে সবচে’ বেশি আন্তর্জাতিক অভিবাসী হিসাবে ইমিগ্রান্ট আর ডায়াসেপারাভারতীয় উপমহাদেশীয়রাই অবস্থান করছে। জাতিসংঘের এক হিসেব থেকে জানাা যায়, পৃথিবী জুড়ে প্রায় ৩০ মিলিয়ন ভারতীয় উপমহাদেশীয় অভিবাসী রয়েছেন। একদিকে হাড়ভাঙা পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থ পাঠিয়ে চাঙা রাখছেন উপমহাদেশের অর্থনীতি, অন্যদিকে অবকাঠামোগত উন্নয়ন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন ছাড়াও নিজের শ্রম, মেধা আর কাজ দিয়ে তারা সমৃদ্ধ করছেন ভিনদেশের অর্থনীতিকে। বিপুল সংখ্যক অভিবাসী পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে মেধা ও শ্রমের মাধ্যমে তাদের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন। ভারতবর্ষ থেকে ছাত্র, গবেষক, ব্যবসায়ী, শ্রমিক, প্রশাসন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, মানে শ্রমিক থেকে বিজ্ঞানী- সমাজের সকল স্তরেই জায়গা করে নিয়েছেন এই অভিবাসীরা। আজ তারাই বিশ্ব সমৃদ্ধির নেপথ্য কারিগর। নানা ভাষা, বর্ণ এবং নানা জাতির মানুষের অভিবাসীদের জীবনযাপন এবং সামগ্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে আদি জাতিসত্তার একটি প্রচ্ছন্ন প্রভাব থেকে মিশ্রসংস্কৃতির সমাজে ইমিগ্রান্ট ও ডায়াসেপারা সমপ্রদায়ের উন্মেষ ও বিকাশ ঘটেছে। এদের পরবর্তী প্রজন্মরাই নির্মাণ করছে নতুন সমাজ, নতুন সংস্কৃতি। এই ভারতীয় উপমাহাদেশীয় অভিবাসীদের বদৌলতেই মাত্র কয়েক দশকে যুদ্ধবিধ্বস্ত বিভিন্ন দেশ পরিণত হয়েছে উন্নত বিশ্বে। এদের কল্যাণেই মানুষ আজকে পৃথিবী নামের এই গ্রহটি ছেড়ে মহাশূন্যের নানাপ্রান্তে ছড়িয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারছে। আর এসব সকলকিছুরই পেছনে কলকাঠি নেড়েছে ‘১৫ আগস্ট’ নাম নিয়ে ক্যালেন্ডারের একটি তারিখ। লাল গোলকে চিহ্নিত করে রাখা একটি দিন। একটি ইতিহাস।
লেখক: গবেষক
তথ্যসূত্র:
মার্গারেট ম্যাকমিলান রচিত ‘দ্য ইউজেস অ্যান্ড অ্যাবিউজেস ও হিস্ট্রি (২০০৮)’
গুগল সার্চ ইঞ্জিন: চেইঞ্জেস আফটার ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার সিচুয়েশন রিপোর্ট ২০১৯
উইকিপিডিয়া মুক্ত বিশ্বকোষ: বাংলা ও ইংরেজি ।