১. অনেক বই
আমি যখন ভারতে থাকতাম, তখনই অনেক বই পড়েছিলাম। বিজ্ঞানের বই, কল্পবিজ্ঞান। তারপর, বাঙালী হওয়ার জন্যে কবিতা, গল্প, উপন্যাস। তাছাড়া, আমাদের বড় হয়ে ওঠার সময়ে নানা বিষয়ে ইন্টারেস্ট ছিল। ভ‚গোল, ইতিহাস এসবও খুব ভালো লাগত। সে সময়ে পাড়ার লাইব্রেরিতে গিয়ে গ্রাহক হয়ে বই নিয়ে আসা, এবং নির্দিষ্ট সময়ে বই ফেরত দিয়ে আসাটা একটা রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা ছিল। ঠিক সময়ে বই ফেরত দেব না, এ আমরা ভাবতেই পারতাম না।
অপরাধবোধ, নিয়ম মেনে চলা, মিথ্যে কথা বলতে পারার অক্ষমতা, খুব কম পেয়েও খুব বেশি খুশি হওয়ার ক্ষমতা- এসব পুরনো দিনের মূল্যবোধ আমাদের ছিল। বইই ছিল খেলার বাইরে আমাদের সবচেয়ে বড় প্যাশন। ইস্কুলের লাইব্রেরি থেকে, কলেজের, ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়া আমাদের খুব একটা আনন্দের বিষয় ছিল।
বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি এসবের বইও অনেক পড়তাম। অনেক বিষয়ে জানতাম। আর বন্ধুদের কাছে বাহবা পাওয়ার জন্যে নানা বিষয়ে জ্ঞান দিতাম। সবাই হাঁ করে শুনত। বুঝতামও না যে শূন্য কলসীতেই বকম বকম শব্দ হয় বেশি।
আমেরিকায় ছাত্র হয়ে আসার পরে বই পড়ার আগ্রহটা দেশের মতো থাকল না। কিংবা বলা যায়, অবকাশ থাকল না। মাস্টার্স বা পিএইচডি ডিগ্রি করার সময়ে এখানে যে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়, আমাদের দেশে নব্বই শতাংশ ছাত্রছাত্রী তা ভাবতেও পারে না। বিশেষ করে আমাদের মতো মধ্যবিত্ত বা গরিব ঘরের ছেলেমেয়েরা, যাদের এদেশে পড়াশোনা করতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে কাজ করতে হয় পড়ার খরচ জোগাড় করার জন্যে।
যেমন, আমি যখন প্রথম এসেছিলাম, তখন নিজের পড়াশোনা, হাজার রকম ক্লাস নেওয়া এবং রিসার্চের সঙ্গে সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে কুড়ি ঘন্টা বাধ্যতামূলকভাবে ডিপার্টমেন্টে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের পড়াতে হতো। সেটাই আমার চাকরি ও সামান্য রোজগার। তার থেকেই বাড়িভাড়া, জিনিসপত্র কিনে নিজে রান্না করে খাওয়া, বইখাতা কেনা, ফোনের খরচ, সবকিছু। তখন ইন্টারনেট ছিল না।
এখানে এসে দেখলাম, বেশি বইটই তেমন কেউ পড়ে না। সায়েন্সের ছাত্রছাত্রীরা সায়েন্সের বইই পড়ে, আর্টস বা লিটারেচার বা পলিটিক্স সম্পর্কে তাদের বিশেষ কোনো আগ্রহও নেই, আর জ্ঞান জাহির করার ব্যাপারটা এখানে একেবারেই নেই।
এমন কী, আমাদের বায়োলজির ছেলেমেয়েরা বায়োলজিরও সব ব্যাপারে জানে না, বা না জেনে সবজান্তা ভাব প্রকাশের কোনো ইচ্ছেও তেমন নেই। একটা উদাহরণ দিচ্ছি। আমি যখন পিএইচডির বাধ্যতামূলক ক্লাসগুলো নিচ্ছি, তখন আমাদের এক নতুন ছোকরা প্রফেসর আর্বানা-শ্যাম্পেন থেকে আমাদের সাদার্ন ইলিনয়ে পড়াতে এলেন নতুন চাকরি নিয়ে। তাঁর ক্লাসে আমরা প্রথম মলিকুলার বায়োলজির পাঠ নিচ্ছিলাম। আমাদের বোটানিতে একটা জিনিস আছে- সি-থ্রি আর সি-ফোর প্ল্যান্টস। মানে, গাছের মধ্যে একধরণের গাছ আছে যারা সালোকসংশ্লেষ করার সময়ে অতিরিক্ত শক্তি তৈরি করে, কারণ তাদের পারিপার্শ্বিক পরিবেশ অত্যন্ত প্রতিক‚ল। আমাদের ক্লাসের কোনো ছাত্র বা ছাত্রীই জানতো না কোন্ কোন্ ফ্যামিলির গাছ এই সি-ফোর শ্রেনির মধ্যে পড়ে। কিন্তু আমি সবজান্তা যেহেতু কলকাতা থেকে এসেছি, আমি গড়গড় করে সেই ফ্যামিলিগুলোর নাম বলে গেলাম। প্রফেসর মুগ্ধ, ক্লাসের আর সব আমেরিকান সহপাঠীরা আরও বেশি মুগ্ধ। বিশেষ করে সহপাঠিনীরা।
কিন্তু আমাদের শিক্ষার দৌড় ওই পর্যন্তই। আমরা মুখস্থ করেছি ফ্যামিলিগুলোর নাম। কিন্তু তার বিশ্লেষণ শিখি নি। এখানে আমেরিকান শিক্ষা ব্যবস্থায় দেখলাম, শক্তিমান মার্কিন সহপাঠী ও সুন্দরী মার্কিন সহপাঠিনীরা হয়ত সেসব নাম জানে না, কিন্তু সি-ফোর উদ্ভিদের ইভোল্যুশন বা বিবর্তন কীভাবে হয়েছে, এবং আজকের এই নিদারুণ উষ্ণায়ন ও পরিবেশ সংকটে সি-ফোর উদ্ভিদের ভ‚মিকা কী কী হতে পারে, তা নিয়ে তাদের জ্ঞান ও বিশ্লেষণ আমাদের থেকে অনেক বেশি। সত্যি কথা বলতে, আমাদের কোনো বিশ্লেষণই নেই।
এই নিয়ে অনেক কথা বলার আছে। বিজ্ঞান চিরকালের মতো ছেড়ে দিয়ে যখন চল্লিশ বছর বয়েসে হিউম্যানিটিজ নিয়ে পড়াশোনা করতে কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম, তখন আবার নতুন করে শিক্ষার এই উদ্দেশ্য উপলব্ধি করলাম। বুঝলাম, পঞ্চাশটা বই পড়লেই, আর নীল নদ কোথায়, অথবা বাবরের জন্ম কত সালে হয়েছিল, তার খবর রাখলেই শিক্ষিত হয় না। শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো ক্রিটিক্যাল থিংকিং। অর্থাৎ, পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, এবং অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি।
আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মোটা মোটা বই পড়েছি আমরা। আমেরিকায় মোটা মোটা বই পড়ার কোনো দামই নেই। এখানে শিক্ষিত মানুষ শূন্য কলসী হয়েও বকম বকম করে না। যেটুকু জানে, ইনসাইড আউট জানে।
২. বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান
আমরা অনেক যত্ন করে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা করেছিলাম। সেই শৈশব থেকে কৈশোরে উত্তরণের সময়ে সূর্যমুখী কাণ্ডের প্রস্থচ্ছেদ আর সমর গুহর রসায়নের বই পাঠ দিয়ে যে বিজ্ঞানচর্চা শুরু হয়েছিল। পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীববিদ্যা, গণিত। নবম শ্রেণী থেকে আমাদের অন্য সব কিছু পড়ার অধিকার কেড়ে নেওয়া হলো। কিন্তু তা অন্য গল্প।
বিজ্ঞানে প্রবেশ করার পর অন্য এক জগৎ চোখের সামনে খুলে গেল। সেখানে ফটোসিনথেসিস না বলে আমরা বলতাম সালোকসংশ্লেষ। কার্বন অ্যাসিমিলেশন না বলে আমরা বলতাম অঙ্গার আত্মীকরণ। অক্সিজেনকে আমরা বলতাম অম্লজান, নাইট্রোজেনকে যবক্ষারজান (জবক্ষার যান নয়), পার্টিকলকে আমরা বলতাম কণা। প্রবাদপ্রতিম শ্যামাদাস মুখার্জীর অঙ্ক ক্লাসে আমরা শ্রীধর আচার্যের গণিত উপপাদ্য বুঝতে পেরে অসীম আনন্দ অনুভব করতাম। ম্যাগনেটকে চুম্বক বলতে, আর ইলেকট্রিসিটিকে বিদ্যুৎ বা তড়িৎ বলতে আমাদের কোনো সমস্যা কখন হয় নি।
রেডিওঅ্যাক্টিভ যে তেজস্ক্রিয়, সেই বাংলাটাই আমাদের কাছে স্বাভাবিক ছিল।
আমাদের স্কটিশ স্কুলের সায়েন্স এগজিবিশনকে আমরা বলতাম বার্ষিক বিজ্ঞান প্রদর্শনী। বোস ইনস্টিটিউটকে বসু বিজ্ঞান মন্দির বলে এসেছি আমরা বরাবর। এই বোস যে জগদীশচন্দ্র বসু, এবং তাঁর বাড়িতেই যে সেই বিজ্ঞান মন্দির, তাও আমরা জানতাম। আমাদের কাছে সেই বাড়িটা তীর্থস্থানের মতো ছিল। নিজের চোখে যখন তাঁর তৈরি করা উদ্ভিদের স্পর্শকাতরতা মাপার যন্ত্র দেখি, শিহরণ অনুভব করেছিলাম। ঠিক যেমন আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে গোয়াবাগান পার্কের গায়ে নতুন বাড়িতে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের উদ্বোধন করতে দেখে অনুভব করেছিলাম। বাংলায় বিজ্ঞান আমাদের কাছে আলো-বাতাসের মতোই প্রাকৃতিক ছিল।
জ্যোতিবাবুর কল্যাণে ইংরিজি তুলে দেওয়ার পর কিন্তু বাংলায় বিজ্ঞান আর বাংলায় বিজ্ঞান থাকল না। কেমন করে যেন মেধাবী বাঙালী ছেলেমেয়েরা তীব্র এক প্রতিক্রিয়ায় ইংরিজির দিকেই আরও বেশি করে ঝুঁকে পড়ল। আজ সেই ভাষা ও মেধা বিপর্যয়ের প্রায় চল্লিশ বছর পরে বাংলায় বৈজ্ঞানিক আলোচনা করা বাংলাভাষীদের কাছেই হাসির খোরাক হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথবা, ভিনগ্রহের জীবের ভাষার মতো। অথচ, সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রামের কলেজে চার বছর অধ্যাপনা করার সময়ে নিজের চোখে দেখেছি বাংলায় বিজ্ঞান পড়তে সেই গরিব কিন্তু মেধাবী ছেলেমেয়েগুলো কী আশ্চর্য আনন্দ অনুভব করে। তাদের কথা আমরা ভাবলাম না। এক অতি কিম্ভুত শিক্ষা ব্যবস্থার বলি হলাম আমরা।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জগদীশচন্দ্র বসুর বাঙালি উত্তর প্রজন্ম আজ বাংলা ভাষায় কথা বলতেই লজ্জাবোধ করে। বিজ্ঞানচর্চা তো দূরের কথা। আর সেই প্রজন্মের নতুন সাহেব হওয়ার স্বপ্নে বিভোর বাবা-মায়েরা একদিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে তাদের জোর করে ঠেলে দিচ্ছে- ভাষা, শিল্প, ইতিহাস ভূগোল সমাজবিজ্ঞান দর্শন পড়ার ‘কোনো দরকার নেই’ বলে, আবার অন্যদিকে ধর্মান্ধতা, প্রাগৈতিহাসিক নিয়মকানুন, গোঁড়ামি ও মধ্যযুগীয় রক্ষণশীল এক রাজনীতির কাছে নিজেদের অস্তিত্বকে বিসর্জন দিচ্ছে। একদিকে প্রবল উগ্র মার্কিনি পুঁজিবাদের উপাসনা, অন্যদিকে ভীষণ প্রাচীনপন্থা।
বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা— দুইই এখন এই যাঁতাকলের মধ্যে পড়ে মৃতপ্রায়।
৩. বাংলার গর্ব
অর্থনীতিতে গত পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলা পঙ্গু হয়ে গেছে বলে- বা বলা যায়, বর্বর ব্রিটিশ থেকে কংগ্রেস ও কম্যুনিস্টরা বাংলাকে শেষ করে দিয়ে গেছে বলে অনেকে বাংলাকে নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। কারণ, তারা অর্থ ও ধনদৌলত ছাড়া জীবনে আর কিছুই বোঝে না। তাদের কথা আমি গ্রাহ্য করি না। সামনে দেখা হলে তারা আমাকে ভয় পায়। আমার সামনে বাংলা ও বাঙালি সম্পর্কে কোনো খারাপ কথা বললে তাদের আমি ‘শেষ করে দেব’।
কিন্তু যেহেতু আমি হিংসা বা ঘৃণাতে বিশ্বাস করি না, তাই তাদের শেষ করে দেব অন্যভাবে। ১. আমি তাদের বাড়ি যাব না, এবং তাদের আমার বাড়িতে কখনও ডাকব না, এবং বাস্তবজীবনে বা সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকবে না। এবং ২. যদি আমার সঙ্গে কোনো সভ্য আলোচনায় তারা আসে, আমি তাদের ইন্টেলেকচুয়ালি শেষ করে দেব। আর আমার সামনে মুখ খুলতে সাহস তারা পাবে না।
এই কাজটা আপনাদের সবাইকে করে যাওয়ার জন্যে অনুরোধ জানাচ্ছি। না, অনুরোধ নয়, দাবি জানাচ্ছি।
বাংলার গর্ব বাঙালির ভাষা, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সঙ্গীত, কারুশিল্প, নৃত্য, অথবা চাঁদ সওদাগর থেকে দ্বারকানাথ ঠাকুর থেকে পূর্ণেন্দু চ্যাটার্জী থেকে অমর বোস এঁদের মতো মহাধনী শিল্পপতি- এও যেমন সত্যি, তেমনই বাঙালির লড়াকু স্বভাব যা বাঙালীদের একদিকে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে সাহায্য করেছে, এবং বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে সফল করতে সাহায্য করেছে। ভারতীয় উপমহাদেশে এমন কোনো জাতি আর নেই যারা একটানা লড়াই চালিয়ে গেছে অত্যাচারী শাসন ও শাসকের বিরুদ্ধে। তার ওপর আমরা হিন্দু মুসলমান মিলিতভাবে এখনও বেঁচে আছি, যা ভারতীয় উপমহাদেশে আজকের দিনে বিরল ঘটনা। আমরা উত্তর ভারতের ফ্যাসিস্ট ও ধর্মান্ধ শক্তিকে পর্যুদস্ত করেছি এই কয়েক মাস আগেও। স্বভাবতই যারা এইসব বিজয়ে ক্রুদ্ধ, তারা বাংলা ও বাঙালির বিরুদ্ধে হিংসা ও ধর্মভিত্তিক ঘৃণা ছড়িয়ে যাচ্ছে, এবং দুই বাংলাতেই তা হচ্ছে।
বাংলা ও বাঙালী কিন্তু এখনও পর্যন্ত তার আত্মাকে বিক্রি করে দেয় নি। যতদিন বাঙালী তার এই গর্ব মনে মনে অনুভব করবে, ততদিন তাকে কেউ তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেও তার সোল অর্থাৎ আত্মাকে শেষ করে দিতে পারবে না। এই গর্ব মেকি গর্ব নয়। এই গর্ব আমাদের দীর্ঘ উজ্জ্বল ইতিহাসের গর্ব।
আমি আঁতেল আলোচনায় বিশ্বাস করি না। তার জন্যে টিভি ও ম্যাগাজিনের পাতায় আঁতেলরা আছেন, রাস্তায় লড়াই করার সময়ে যাঁদের টিকি, দাড়ি, চশমা বা উদগ্র নাসারন্ধ্রের খোঁজ পাওয়া যাবে না। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, নিজের জীবন দিয়ে অ্যানটি-আঁতেল রাস্তার লড়াই চালিয়ে যাব।
আপনারা যদি মনে করেন আমি আলোচনার যোগ্য, আলোচনা করবেন। আমি থাকব।