উত্তরাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র রাজশাহী। স্বাধীনতার আগ থেকেই রাজশাহী শিক্ষানগরী হিসেবেই পরিচিত। ব্রিটিশ ভারতেও রাজশাহী কলেজের স্থান ছিল কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের পরই। এছাড়া ছিল কলেজিয়েট স্কুল, লোকনাথ স্কুল, হাই মাদ্রাসা, মেডিকেল স্কুলের মতো বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পাকিস্তান আমলেও এর ধারাবাহিকতা বজায় থেকেছে। অল্প সময়ের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় পরবর্তীতে মেডিকেল কলেজ, তারপর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ অসংখ্য স্কুল-কলেজের কারণে শিক্ষানগরী হিসেবেই রাজশাহী এগিয়ে চলেছে।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রাম-এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ছাত্র আন্দোলনই জাতিকে পথ দেখিয়েছে, সেটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। শিক্ষা বিষয়ক নিজস্ব আন্দোলনের পাশাপাশি সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনেও পিছিয়ে ছিল না ছাত্র সমাজ। ছাত্রদের সংগঠিত শক্তির ওপর ভর করেই যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বায়ত্তশাসন, স্বাধীকারের আন্দোলনকে স্বাধীনতার আন্দোলনে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে, একথা আজ আর অজানা বিষয় নয়। রাজশাহীর ছাত্র আন্দোলন জাতীয়ভিত্তিক ছাত্র আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু ছিল না। থাকার কথাও নয়। তাই কেন্দ্রীয় আন্দোলনের অংশ হিসেবেই এর জন্ম ও বিকাশ ঘটেছে স্বাভাবিকভাবেই। ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমেই এদেশে ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তার পটভূমি আলোচনা করাটা পাঠকদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটাবে না বলেই আশা করি।
ভাষা আন্দোলনের পটভূমি
পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র তিনমাস পরে (১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে) তৎকালীন রাজধানী করাচিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই খবর ৬ ডিসেম্বর ঢাকার মর্নিং নিউজ পত্রিকায় ছাপা হলে শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। তারা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ওই দিনই দুপুর দুটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ, জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজসহ অন্যান্য কলেজ ও স্কুলের ছাত্ররা এক প্রতিবাদ সভা করে। এতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও তমুদ্দুন মজলিশের সম্পাদক আবুল কাশেম। বক্তৃতা করেন অধ্যাপক মুনির চৌধুরী, একেএম আহসান প্রমুখ এবং প্রস্তাব পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ফরিদ আহমদ। উল্লেখ্য, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এটাই ছিল সর্বপ্রথম সাধারণ ছাত্র সভা।
সমাবেশের পর বিশাল ছাত্রমিছিল সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। সেখানে কৃষিমন্ত্রী মোহাম্মদ আফজাল বক্তৃতা করেন এবং ছাত্রদের আন্দোলন সমর্থন করেন। এরপর ছাত্ররা প্রাদেশিক মন্ত্রী নূরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী এবং প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের বাসভবনেও যান। তাদের কাছ থেকে বাংলার পক্ষে মৌখিক সমর্থন আদায় করেন। প্রধানমন্ত্রী লিখিত আশ্বাসও দেন। ছাত্রদের মিছিল মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনেও বিক্ষোভ করে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রমিছিল ঢাকার রায় সাহেব বাজারে পৌঁছলে ক্ষমতাসীন মুসলীম লীগের লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে তাদের ওপর হামলা চালিয়েছিল। খাজা নাজিমউদ্দিন সরকারের পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের ভাড়াটে গু-ারা ভাষার আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমননীতির মাধ্যমে নস্যাৎ করে দিতে অপপ্রয়াস পায়।
দমন-পীড়ন প্রতিরোধে খুব দ্রুতই ভাষাসংগ্রাম রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয় এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এসময় কেন্দ্রে বাঙালি শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের উদ্যোগে আরবি হরফ প্রবর্তনের চেষ্টা করা হয়। তিনি ছাত্রদের চাপের মুখে ১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আলোচনার পর মানি অর্ডার ফরম, ডাকটিকিট ও মুদ্রায় ইংরেজি, উর্দুর পাশাপাশি বাংলা লেখার আশ্বাসও দেন। কিন্তু বাস্তবে তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে মুসলিমলীগ সরকার ছল চাতুরির মাধ্যমে বাঙালিদের শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে থাকে। অবশ্য তারও আগে ১৯৪৭ সালে ৭ সেপ্টেম্বর বামধারার অনুসারি গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও ১৫ সেপ্টেম্বর অসাম্প্রদায়িক সংগঠন তমদ্দুন মজলিশ বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করার দাবি জানিয়েছিল।
১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান রাজশাহী সফরে আসলে চরম ছাত্র বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। ফলে, সংবর্ধনার নাম করে যে শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়েছিল তাও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ২১ নভেম্বর ছাত্রদের ওপর গু-াবাহিনী লেলিয়ে দেয়া হয়। অন্যদিকে রাজশাহী সরকারি কলেজের ছাত্র নেতা আবুল কাশেম চৌধুরী, মুহাম্মদ সুলতান ও গোলাম রহমান (দিনাজপুর)সহ ষোলজনকে রাজশাহী কলেজ থেকে বহিষ্কার করা হয়।
রাজশাহীতে ছাত্র ফেডারেশন (তৎকালে শক্তিশালী ছাত্র সংগঠন যা অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল ভাবধারার অনুসারী ছিল ) নেতৃবৃন্দসহ অন্য কয়েকজন ছাত্রকে বহিষ্কার এবং ঢাকাসহ পূর্ব বাংলার সর্বত্র ছাত্রদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের প্রতিবাদে ১৯৪৮ সালের ৮ জানুয়ারি ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালনের আহবান জানানো হয়। ঢাকাতে একমাত্র ঢাকা কলেজ ব্যতীত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পূর্ণ ধর্মঘট পালিত হয়। দুপুর ২ টায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা নঈমুদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে ছাত্রসভা হয় এবং সরকারকে দাবিসমূহ মেনে নিতে এক মাসের সময় বেঁধে দেয়া হয়।
রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা
ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ভাষা বিষয়ক বিতর্ককে কেন্দ্র করে। ২৫ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও সরকারি ভাষা করার প্রস্তাব করেন। তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হবার সংবাদে ঢাকাসহ সারাদেশের ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
রাজশাহীতে ভাষা আন্দোলনের সূচনা
গণপরিষদে বাংলাভাষার দাবি প্রত্যাখ্যাত হবার পর রাজশাহীতেও প্রচ- বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ১ মার্চ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, রাজশাহীতে ২৫ ফেব্রুয়ারি স্কুল ও কলেজের ছাত্ররা ব্যাপকভাবে ধর্মঘট পালন করে। বেলা ১১ টায় ভুবনমোহন পার্কে ছাত্রদের সভা হয় কাজী জহুরুল হকের সভাপতিত্বে। পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা রূপে বাংলার দাবি সমর্থন করে কয়েকজন ছাত্র বক্তৃতা করেন। সেখান থেকে বহুসংখ্যক ছাত্রের স্বাক্ষরযুক্ত স্মারকপত্র গণপরিষদের সভাপতি ও পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠাবার ব্যবস্থাও করা হয়।
২৭ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর নওগাঁয় গণপরিষদে প্রদত্ত লিয়াকত আলী খান ও খাজা নাজিমু্িদনের বক্তৃতার প্রতিবাদ করে সিরাজুদ্দিন সাহেবের সভাপতিত্বে বিরাট সভা হয়। সেখানে নবিউদ্দিন, মুসলিম ছাত্রলীগের সম্পাদক সমিরুদ্দিন, যুবলীগের আতাউর রহমান, মুসলিম লীগ সম্পাদক ইব্রাহিম চৌধুরী বক্তৃতা করেন। তারা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, বাংলা ভাষাকে অবহেলা করার অর্থ পাকিস্তানের মৃত্যু। সভায় গণপরিষদের ভাষাবিরোধী সদস্যদের পদত্যাগও দাবি করা হয়।
বাংলাভাষার দাবি প্রত্যাখানের প্রতিবাদে নাটোরেও হরতাল পালিত হয়। নাটোর মহকুমা মুসলিম ছাত্রলীগের উদ্যোগে ১ মার্চ নাটোর শহরে হরতালের সময় সমস্ত দোকান, স্কুল বন্ধ ছিল। বিকেলে চৌধুরী সাহেবের মাঠে হিন্দু-মুসলমান ছাত্র ও জনসাধারণের এক মিলিত সভা শ্রীযুক্ত প্রতিভাকুমার চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভা থেকে বাংলা ভাষাকে পূর্ব বাংলার রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে এক সর্বসম্মত প্রস্তাব পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হয়।
১১ মার্চ রাজশাহীতে হরতাল পালনকালে বাংলাভাষা বিরোধীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। সেদিন নগরীর স্কুল, কলেজে ধর্মঘট সফল হলেও সরকার সমর্থক ও অবাঙালিরা বাধা সৃষ্টি করে। রাজশাহীতে হরতালে নেতৃত্ব দেন রাজশাহী কলেজের ছাত্র নেতা মোহাম্মদ সুলতান ও গোলাম রহমান (দিনাজপুর), গোলাম তোয়াব (সাবেক বিমান বাহিনী প্রধান), তোফাজ্জুল হোসেন প্রধান তুফুল প্রমুখ। স্থানীয়দের মধ্যে ছিলেন মুহাম্মদ একরামুল হক, আবুল কাশেম চৌধুরী, আতাউর রহমান, কসিমুদ্দিন আহমদ, নুরুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান শেলী (সাবেক প্রধান বিচারপতি)সহ আরও অনেকে। হরতাল বিরোধীদের হামলায় প্রহৃত হন গোলাম তোয়াব, রক্তাক্ত হন ছাত্রনেতা গোলাম রহমান। সরকারি গুণ্ডাদের লাঠির আঘাতে তার মাথা ফেটে যায়। এই রক্ত ভাষার জন্য দেশের প্রথম রক্তদান বলে রাজশাহীর ভাষা সৈনিকদের দাবি।
এর পরপরই ১৯৪৮-এর এপ্রিলে রাজশাহী কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচন হয়। নির্বাচনী প্রচারণায় ভাষা আন্দোলনকারীদের পাকিস্তানের শত্রু, ভারতীয় চর, কমিউনিস্ট প্রভৃতি আখ্যা দিয়ে পাকিস্তান রক্ষার জিগির তোলা হলেও সরকার সমর্থকরা সুবিধা করতে পারে নি। বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে মোহাম্মদ সুলতান ও হাসনা বেগম ছাত্র সংসদের প্রথম অধিবেশনেই বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি তোলেন এবং তা কার্যবিবরণীতে লিপিবদ্ধ করার দাবি জানান। এতে সংসদের সভাপতি কলেজ অধ্যক্ষ ড. মমতাজউদ্দিন আহমদ রাজী না হলে তারও প্রতিবাদ জানান তারা। ঘটনার প্রতিবাদে মিছিল ও হরতাল প্রায় প্রতিদিনের ঘটনায় পরিণত হলে কলেজ কর্তৃপক্ষ এজন্য দায়ি করে একরামুল হকসহ ১৫/১৬ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করে। এর প্রতিবাদে ৩৬ জন ছাত্র কলেজ প্রশাসন ভবনে ঢুকে আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। রাজশাহী কলেজের এই অভূতপূর্ব অনশন শহরের সব স্তরের মানুষের সহানুভূতি আকর্ষণ করে। অনশনের ষাট ঘণ্টা পরে মুসলিম লীগ নেতা ও আইন পরিষদ সদস্য মাদার বকশ অন্যান্য নেতাদের নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন এবং কলেজ অধ্যক্ষের ঘর থেকে ফোনে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের সাথে কথা বলে বাংলাভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে কাজ করতে তার প্রতিশ্রুতি এবং ছাত্রদের বহিষ্কারাদেশ তুলে নেয়ার ব্যবস্থা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করেন।
১৯৪৮ সালের শেষ দিকে মুহম্মদ একরামুল হক পুনরায় গ্রেফতার হন। তার আগেই আতাউর রহমানও গ্রেফতার হন। পরে কাশেম চৌধুরীকেও গ্রেফতার করা হয়। হাবিবুর রহমান শেলী ও মুহম্মদ সুলতান পড়াশুনার জন্য ১৯৪৯ সালে ঢাকায় চলে যান। ফলে রাজশাহীর ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দেয়। তবে তা পূরণে সময় লাগে না। নতুন নেতৃত্ব দানে এগিয়ে আসেন এস.এ. বারী এটি (দিনাজপুর), গোলাম আরিফ টিপু, আহমদউল্লাহ্ চৌধুরী (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), মো: আনসার আলী, মহসীন প্রামাণিক, আবুল কালাম চৌধুরী, এস.এম এ গাফফার, হাবিবুর রহমান প্রমুখ।
রাজশাহীতে একুশে ফেব্রুয়ারি
২১ ফেব্রুয়ারির আগেই অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীর ভুবনমোহন পার্কে তমদ্দুন মজলিশ রাজশাহী শাখার উদ্যোগে জনাব আনসার আলীর সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয়। সভায় জনাব শামসুল হক, যুবনেতা মোহাদ্দরুল হক বক্তৃতা করেন। তারা পূর্ববাংলার রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষণার তীব্র সমালোচনা করেন। সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বাংলাকে পূর্ববঙ্গের রাষ্ট্রভাষা করা, আরবি হরফের প্রচলন বন্ধ করা, অবিলম্বে রাজশাহীতে উচ্চ বিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ স্থাপনাসহ বিভিন্ন দাবি করা হয়। এসব দাবির সমর্থনে আগামী ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে সমস্ত স্কুল-কলেজ এবং ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের সংকল্প গৃহীত হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ দেশের প্রত্যেক জেলায় স্বতঃর্স্ফুতভাবে ধর্মঘট পালিত হয়। বিভিন্ন জেলায় যেভাবে বিক্ষোভ ও আন্দোলন হয় তা ব্রিটিশ আমলেও দেখা যায় নি বলে স্মৃতিচারণে তমদ্দুন মজলিশের অধ্যক্ষ আবুল কাশেম উল্লেখ করেন।
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা মর্যাদা দানের দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট চলাকালে রাজশাহীতে সমস্ত দোকানপাট বন্ধ থাকে, টমটমগাড়ি ও রিকশাওয়ালারাও ধর্মঘট পালন করেন। শহরে সারাদিন বন্দুকধারী পুলিশ টহল দেয়। বেলা ১১টায় রাজশাহী কলেজ থেকে এক হাজারের বেশি ছাত্র-জনতার শোভাযাত্রা বাংলার দাবিতে স্লোগান দিয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে। বিকাল ৪টায় ভুবনমোহন পার্কের বিশাল জনসভায় সভাপতিত্ব করেন রাজশাহী কলেজের ছাত্র নেতা হাবিবুর রহমান। শামছুল হক, আব্দুস সাত্তার, বেগম জাহানারা, মান্নান প্রমুখ বক্তৃতা করেন। বক্তৃতাকালেই ঢাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হবার খবর প্রচারিত হলে উপস্থিত জনতা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। জ্বালাময়ী বক্তৃতার মধ্যেই পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি শহীদদের আত্মার মাগফেরাত ও জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে ভুবনমোহন পার্কে জনসভার কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
দেশের প্রথম শহীদ মিনার
ঢাকায় পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনা ও পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পরপর রাজশাহী কলেজের নিউ মুসলিম হোস্টেলে এক ছাত্রসভায় ২২ ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহীতে সর্বাত্মক হরতালের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেখানে আলোচনা করেই সারা রাত ধরে ইট ও কাদা দিয়ে নিউ মুসলিম হোস্টেলের মেইন গেটের সামনে হোস্টেলের ভেতরে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হয় এবং পরদিন সকাল ৭টার দিকে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
রাতের সেই সভাতেই মেডিকেল স্কুলের ছাত্র এস.এম.এ. গাফফারকে সভাপতি এবং হাবিবুর রহমান ও গোলাম আরিফ টিপুকে সম্পাদক করে একটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এই সংগ্রাম পরিষদের কর্মকর্তারা মিটিং শেষে ২১ তারিখ রাতেই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভের কাজ শুরু করেন। শেষ হতে সকাল হয়ে যায়। ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টার দিকে ছাত্ররা হরতালের পিকেটিং করার জন্য বেরিয়ে গেলে পুলিশ এসে মিনারটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। তার একটি ফটো ভাষাসৈনিক মহসিন প্রামাণিক রক্ষা করেছেন। ঢাকায় ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণে হতাহতের ঘটনার পর সান্ধ্য আইন জারি হওয়ায় সেখানে শহীদ মিনার তৈরির পরিবেশ ছিল না। ২২ তারিখ গভীর রাতে তথা ২৩ তারিখে ঢাকায় শহীদ মিনার নির্মিত হয় যা প্রথমবার উদ্বোধন করেছিলেন শহীদ শফিউরের পিতা লক্ষ্মীবাজার নিবাসী মৌলভী মাহবুবুর রহমান। দ্বিতীয় বার ২৬ ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন করেছিলেন দৈনিক আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন। সে দিনই সেনাবাহিনীর সমর্থনপুষ্ট হয়ে একদল সশস্ত্র পুলিশ সেই ঐতিহাসিক শহীদ মিনার ধূলিস্যাৎ করে দেয়।
শহীদ মিনার ভাঙা সম্ভব হলেও আন্দোলন দমানো সম্ভব হয় নি। ২২ ফেব্রুয়ারি ভুবনমোহন পার্কে সংগ্রাম পরিষদ আয়োজিত সভায় হাজির ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা ও প্রাদেশিক আইন পরিষদ সদস্য মাদার বকশ, জননেতা ক্যাপ্টেন শামসুল হকসহ আরও অনেকে। এই দুই মুসলিম লীগ নেতা সেদিন নূরুল আমিনের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষায় বক্তৃতা দেন। সংসদ সদস্য ও রাজশাহী পৌরসভার সভাপতি মাদার বকশ বলেন, খুনী নূরুল আমিন সরকারের আইন পরিষদের একজন সদস্য হিসেবে আপনাদের সামনে দাঁড়াতে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। যদি বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া না হয়, তবে আমি পরিষদের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করব। এই সভায় বক্তৃতা দেওয়ার কারণে মাদার বকশ, ক্যাপ্টেন শামসুল হক, মজিবর রহমান অ্যাডভোকেট, বিশিষ্ট লেখক, রাজনীতিবিদ ও রাজশাহী পৌরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান মোক্তার জিয়ারত হোসেন, আবদুল সাত্তারসহ ১১ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়।
রাজশাহী ছাড়াও নাটোর-নওগাঁ-চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ বৃহত্তর রাজশাহী জেলার সর্বত্রই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। এক্ষেত্রে মহিলারাও পিছিয়ে ছিলেন না। নাটোরের মহিলারা ভাষা আন্দোলন সমিতি গঠন করেন এবং প্রতিবাদ সভা করে গুলিবর্ষণকারী ব্যক্তিদের বিচার দাবি করেন। রাজশাহীতেও মহিলাদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বদানে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন বেগম জাহান আরা বেনু (ডক্টর), বেগম মনোয়ারা রহমান, মেডিকেল স্কুলের মোহসিনা বেগম (ডাক্তার), হাফিজা বেগম টুকু, হাসিনা বেগম, রওশন আরা, সারা খন্দকার, জাহানারা লাইজু, খুরশীদা বানু প্রমুখ। বেগম জাহান আরা রাজশাহীতে প্রথম মহিলা যিনি ভুবনমোহন পার্কে ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা, আজ জেগেছে সেই জনতা’ গান গেয়ে সকলকে আলোড়িত করেছিলেন এবং প্রশংসা কুড়িয়েছেন। তার গানের উদ্দাম সুরের মুর্ছনায় মুহুর্তেই শোক যেন শক্তিতে পরিণত হয়েছে। বুকে বুকে রক্তের কল্লোল যেন মহামুক্তির মিলনের পথ খুঁজে পেয়েছে।
সেই পথ ধরেই পরবর্তীতে শিক্ষা আন্দোলন, সামরিক শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বাধীকার ও স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন, ৬ ও ১১ দফার আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ লাভ করেছি। এই দীর্ঘ পথপরিক্রমায় ছাত্র-তরুণদের ভূমিকা ছিল অগ্রগামী। তাদের আন্দোলনেই দেশজুড়ে গণজাগরণের সূচনা হয়েছিল। সরকার ও শাসকদলের লাগাতার অপপ্রচার, দমন-পীড়ন সত্ত্বেও ছাত্র আন্দোলন স্বতঃস্ফুর্ত জনসমর্থন লাভ করেছে। জাতীয় আশা-আকক্সক্ষার ধারক-বাহক হয়ে উঠেছে। তাদের ওপর ভর করেই রাজনৈতিক দল জাতীয় নেতৃত্ব অর্জন করে অবশেষে রাষ্ট ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে।
বাংলাভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন থেকেই বাঙালি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শিখেছে। যা বাঙালি জাতিয়তাবাদী চেতনার জন্ম দিয়েছে বলেই জাতি রাষ্ট্র হিসেবে আজ আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি। যেখানে মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এখনও চলমান। সাধারণ মানুষের অধিকারের নিশ্চয়তা ছাড়া যে মাথা উঁচু করে বাঁচা যায় না দৈনন্দিন জীবনের পদে পদে ঠিকই তা টের পাওয়া যায়। তাই ভাষা আন্দোলনের শিক্ষা মাথা নত না করা আজও মানুষের চেতনা জাগ্রত করে, শাণিত করে। বিশেষ করে ছাত্র-তরুণদের মধ্যে এর প্রকাশ আগের মতোই দৃশ্যমান!
[ভাষা আন্দোলনের ওপর বিভিন্ন গবেষণাপত্র ও পুস্তিকার সূত্র অবলম্বনে এই লেখা ]
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক