মিল্টন ভাই তাঁর বউকে অসম্ভব ভালোবাসেন। বউয়ের শাড়িটা-চুড়িটার প্রতি তার গভীর মনোযোগ। সেই বিয়ের পরপর সময়ে যখন তিনি দূরে চাকরি করতেন, যখন বউয়ের কাছে আসতে পারতেন শুধু বৃহ¯পতিবার, যখন বৃহ¯পতিবার রাত তার কাছে হাজার রাতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে হতো- তখনকার সময় থেকে আজ পর্যন্ত এতটুকু ফিকে হয় নি বউয়ের প্রতি তার মনোযোগ।
বন্ধুদের কেউ কেউ মিল্টন ভাইকে খেপাতে চেষ্টা করেন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমনও বলেন, বউ যদি বলে চাঁদ এনে দিতে হবে, তবে মিল্টন ভাই চাঁদ বরাবর টুল রেখে টুলের ওপর দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে লাফালাফি করে চাঁদ ধরতে চেষ্টা করবেন। পারবেন না হয়ত কিন্তু চেষ্টা করবেন। আর অন্য বন্ধুরা তখন হাসাহাসি শুরু করে দেয়। যে যা বলুক, যত ইচ্ছা হাসাহাসি করে করুক, মিল্টন ভাই মনে করেন তিনি তো কোনো অন্যায় করছেন না। বউয়ের দিকে মনোযোগ থাকা অন্যায় কিছু নয় তো। কাজেই বন্ধুদের হাসাহাসি, টিপ্পনী কাটার বিষয়টাকে মিল্টন ভাই আমলে নেন না ততটা।
মিল্টন ভাই চাকরি বদলি করে এখন তিনি আর বউ একই শহরে থাকেন। বউও তার বিরাট শিক্ষিত। চাকরি-বাকরি করা বউ মিল্টন ভাইয়ের। কিন্তু এই শিক্ষিত, ভালো, ভদ্র, নম্র, সভ্য স্বভাবের বউকে মিল্টন ভাই কেন যে এত ভয় পান সেটা তিনি বুঝতে পারেন না। বউ তার রাগী নন। কিন্তু বউয়ের সামনে এলে মিল্টন ভাই সব এলোমেলো করে গুলিয়ে ফেলেন।
মিল্টন ভাইয়ের বউ তাকে আখরোট খাবার পরামর্শ দিয়েছেন। আখরোট খেলে নাকি হাবাহাবা ভাব দুর হয়ে যায় আর স্মৃতিশক্তি বাড়ে। মিল্টন ভাই সেই আখরোট চিনতেন না। পরে নেটে সার্চ দিয়ে চিনলেন ও জানলেন। আখরোট নাকি বালু এলাকায় জন্মানো গাছের ফল। এই আখরোটের খবর বউ কিভাবে পেল সেটা তিনি ভাবতে থাকেন এবং লুকিয়ে লুকিয়ে আখরোট খেতেও শুরু করেন।
কিন্তু আখরোট খাবার বিষয়টা তার অতি চালাক বউ কেমন করে যেন ঠিকই ধরে ফেলল। তারপর কড়া চোখে জানতে চাইল, লুকিয়ে রাখার কারণটা। বউয়ের কড়া চোখ দেখে মিল্টন ভাই সব গুবলেট করে দিয়ে বলতে শুরু করলেন, আখরোট গাছের বৈজ্ঞানিক নাম জুগল্যান্স রিজিয়া যা জুগল্যান্ডাসি গোত্রের পর্নমোচী বৃক্ষ। এই গাছ…
চুপ! বউ ধমকে উঠে আবারো জানতে চাইল, বাইরের লোকজনের সামনে এত সেন্স অফ হিউমার স¤পন্ন লোক, আর বউয়ের সাথে কথা বলার সময় এত হাবা হয়ে যাও কেন?
হায়! মিল্টন ভাইয়ের কাছে সেই উত্তর জানা নেই।
এমনিতেই রোজার মাস এখন। বউ রাতের বেলা সেই যে নামাজ পড়তে শুরু করেন আর শেষ হয় না। কতদিন বউয়ের সাথে আরাম করে ঘুমানো হয় না! ভাবতে ভাবতে মিল্টন ভাইয়ের চোখে জল এসে যায়। ভাগ্যিস বউ দেখে ফেলে নি! তাহলে ঠিকই দু’য়ে দু’য়ে চার মিলিয়ে সব নিজেই বের করে নেবে। আবারও এলোমেলো হয়ে যাবেন মিল্টন ভাই।
বউ সেদিন ইফতারিতে হালিম রান্না করবেন বলে মিল্টন ভাইকে বললেন, এই শুনছ, আজকে বাজার থেকে হাড়ওয়ালা মাংস এন তো?
মিল্টন ভাইও খুব খুশি মনে বাজার করে আনলেন। ইফতারিতে হালিম খেতে গিয়ে মিল্টন ভাই দেখেন স্যুপ জাতীয় অর্ধতরল পদার্থ। জিজ্ঞাসু চোখে বউয়ের দিকে চাইতে বউ বলল, তোমাকে হাড়ওয়ালা মাংস আনতে বলেছিলাম, নিয়ে এসেছ কিমার মাংস।
মিল্টন ভাই বুঝলেন বউ তাকে শিক্ষা দিয়ে শিক্ষিত করে তুলতেই কিমার মাংস দিয়েই হালিম রান্না করেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মিল্টন ভাই স্বগতোক্তিতে বললেন, আমার পুরো জীবনটাই একটা শিক্ষা সফর। মিল্টন ভাইয়ের বউ তাকে অবিরাম শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বেচারা মিল্টন ভাইয়ের কোনো লাভই হচ্ছে না। হালিম আর গলা দিয়ে নামল না সেদিন।
রোজা প্রায় শেষ হয়ে আসছে। মিল্টন ভাইয়ের বউয়ের জন্য অপেক্ষা আর শেষ হয় না যেন। ঈদকে সামনে রেখে চাকরি বাকরি ছুটি হয়ে গেল। বউ আবারও মহা উৎসাহে মিল্টন ভাইকে সাথে নিয়ে বাজার করতে গেল। উইমেন্স ওয়ার্ল্ড বিউটি পার্লার অ্যান্ড শপিং হাউজ থেকে এক রাজ্য জিনিস কিনে ফেলল। এরই মধ্যে দেখা হয়ে গেল বউয়ের বান্ধবী সুমাইয়া, নাবিলা, রিদিতা আর আরও ক’জন সঙ্গে। বউ খুশিতে ঝলমল করতে করতে বান্ধবীদের সাথে গল্প করতে লাগল।
মিল্টন ভাই দেখতে থাকেন একগাদা সুন্দরী মেয়ে কলকল করে কথা বলেই যাচ্ছে। সবাই বলছে। কে যে কার কথা শুনছে মিল্টন ভাই বুঝতে পারেন না। টানা তিন ঘন্টা ধরে তারা কথা বলল, হাসল আর জামাকাপড় কিনল। কেউ কারো কথা শোনে নি। সবাই একসাথে বলেছে আর একসাথে হেসেছে।
কেউ কেউ আহøাদ করে মিল্টন ভাই, মিল্টন ভাই বলে এটা ওটা জিজ্ঞেস করেছে, মিল্টন ভাই দেখেন তো এই কালারটা আমাকে মানিয়েছে? মিল্টন ভাই এই ডিজাইনটা কেমন লাগছে? – এসব।
মিল্টন ভাই হাসি হাসি মুখ করে বসে রইলেন আর সুন্দরীদের কাজকর্ম দেখলেন। বউয়ের বিল আসলো তেইশ হাজার নয়শ’ ছাপান্ন টাকা। মিল্টন ভাই বিল পরিশোধ করে বউয়ের হাত ধরে নিচে নেমে গেলেন।
নীচে নেমে হঠাৎ দেখেন যার হাত ধরে নেমে এসেছেন তিনি তার বউ নন, বউয়ের বান্ধবী সুমাইয়া। সবজনকে একইরকম দেখতে আসলে লাগছিল, এজন্যেই মিল্টন ভাই ভুলটা করে ফেলেছেন। সুমাইয়ার হাত ছেড়ে দিতেই বউ আর তার বান্ধবীরা হেসে গড়াগড়ি খেতে লাগল। মিল্টন ভাই লাল-নীল-বেগুনি হতে লাগলেন। আখরোট খেয়ে কাজ হচ্ছে না মনে হয়। তিনি বোকা হাবাই রয়ে যাচ্ছেন।
সেদিন ইফতারিতে মিল্টন ভাই নিজের হাতে পেঁয়াজু-বেগুনি ভেজে বউকে খাওয়াবেন বলে কথা ছিল। সেখানেও আরেক কেলেংকারী। বউয়ের রান্নাঘরের সাহায্যকারীরা যেন হেডমাস্টার হয়ে উঠেছে।
আমেনা খালা বলে, চুলার জ্বাল কমিয়ে রান্না করতে হয় তো!
স্বপ্না খালা বলে, আরে! না না! বেকিং পাউডার দেওয়া যাবে না!
এক খালা বলে, ভাজা হয়ে গেছে তো আরেক খালা বলে আরও ভাজতে হবে। এদের জ্ঞান বুদ্ধি দেখে মিল্টন ভাই ভাবেন এরা অফিসে চাকরি না করে রান্নাঘরে কাজ করছে কেন? এদের অতিরিক্ত পরামর্শের ঠেলায় মিল্টন ভাই দ্বিতীয়বার বেগুনি না দিয়ে নিজের আঙুলটা তেলের মধ্যে দিয়ে দিলেন।
ভাগ্যিস তেল বেশি গরম ছিল না। কিন্তু আমেনা খালার চিৎকারে বউ ছুটে এল রান্নাঘরে। এসেই আঙুলটা ধরে একদম মুখের কাছে নিয়ে ফুঁ দিতে লাগল।
মিল্টন ভাইয়ের কি যে ভালো লাগছে! আহা বউটা! মনে মনে আমেনা খালাকে ধন্যবাদ দিয়ে দেয়। বউটা কি আদর করে তাঁকে ঘরে নিয়ে গেল!
চাঁদ উঠে গেছে। কালকে ঈদ। চাঁদ ওঠার পর শুরু হলো বউয়ের রান্নাবান্না। বউ তার অনেকগুলো সাহায্যকারী নিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই রান্না শেষ করে ফেলল। মিল্টন ভাইকে সবগুলো রান্না চেখে দেখতে হলো। মিল্টন ভাই নিজেও বউয়ের সাহায্যে নিয়ে ফিরনি রেঁধে ফেললেন। ফিরনি রান্না শেষে খেয়ে দেখার পর নিজেকে সিদ্দিকা কবীরের ভাই বলে মনে হতে লাগল। অত্যন্ত সুস্বাদু হয়েছে সে ফিরনি। বউ অবশ্য দাবি করে বসল ফিরনি মজাদার হবার পেছনে সমস্ত কৃতিত্বই তার, কারণ তিনি নাকি ফিরনির মধ্যে কাজুবাদাম, পেস্তাবাদাম, কিশমিশ সংযুক্ত করে খাবারটাকে সুস্বাদু করে তুলেছেন।
এরই মধ্যে মিল্টন ভাইয়ের চাচাত, মামাত আরও যত শালীরা আছে তারা ফোনে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতে শুরু করেছে। তাদের আহøাদী কন্ঠে মিল্টন ভাইয়ের দিশেহারা লাগে। কাল কে কখন বেড়াতে আসবে, মিল্টন ভাইকে কে কখন নিয়ে যাবে তার পরিকল্পনা চলল অনেকক্ষণ ধরে।
এদিকে ঘর-রান্নাঘর গুছিয়ে বউ মেহেদী নিয়ে বসল এবং মিল্টন ভাইকে অবাক করে দিয়ে দুই হাত ভরতি করে মেহেদী লাগিয়ে ফেলল। মিল্টন ভাই করুণ চোখে তাকিয়ে থাকেন। কোথায় ভাবলেন, অনেকদিন পর আরাম করে বউকে নিয়ে ঘুমানো যাবে! কিন্তু এই মেহেদী সব পরিকল্পনা নষ্ট করে দিবে।
দুঃখিত চিত্তে মিল্টন ভাই শুয়ে পড়বেন বলে ভাবছেন। হঠাৎ বউ জানালো তিনি নাকি ওয়াশরুমে যাবেন। এই কথা শুনে এক মুহূর্তে মিল্টন ভাই হিসাব করে ফেললেন তাহলে মেহেদী তুলে ফেলতে হবে। এবং খুশিতে বউকে জড়িয়ে দীর্ঘ চুমু দিয়ে ফেললেন। দুই হাত ভরতি মেহেদীর জন্য বউও ততটা জোরাজুরি করতে পারলেন না। এবার মিল্টন ভাই মেহেদী লাগানো উপলক্ষ্যটাকে ধন্যবাদ দিয়ে ফেললেন। বউ নিজেকে ছাড়িয়ে নিল ঠিকই এবং অতটা রাগও করল না আর। লজ্জা লজ্জা চোখে মিল্টন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে বললেন। হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আসছেন বলে জানিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলেন।
কিন্তু হায়! মিল্টন ভাইয়ের অপেক্ষা যেন শেষ হয় না আর।
বগুড়া থেকে