সাদা লাল শাড়ি মোটে দুইটা আছে। গত বছরে সেসব পরে- টরে শেষ। এখন? ফুল ছোপ ছোপ, রঙ-টঙওয়ালা কাপড় দিয়ে চালিয়ে দিবে নাকি সে? এদেশ থেকে কেনা মানে বাড়তি ত্রিশ/চল্লিশ ডলার। করোনার কারণে দেশেও যাওয়া হয় না ম্যালাদিন। তাই যখন রোজা আর পয়লা বৈশাখ একই দিনে পড়ল, মনে মনে খুশিই হলো নীলা। কিন্তু এদেরও যে কি এনার্জি! বাবা! ঠিকই বুদ্ধি করে এক সপ্তাহ আগের রবিবার পয়লা বৈশাখের আয়োজন করে ফেলল বড় বাংলাদেশি গ্রুপটা। তার আগের শনিবারেই আছে তাদের ইউনিভার্সিটির দেশি স্টুডেন্টদের বৈশাখী আয়োজন। বিদ্রোহী বাংলাদেশি গ্রুপ আছে একটা; তারাও কিসব আয়োজন করছে; আর সেটা আজকেই।
নীলা ভ্রু কুঁচকায়ে শাড়ি খোঁজে। যতই গ্রুপিং হোক, যাবে তো সেই একই মানুষের দল, সেই পরিচিত পাঁচ ছয়শ’ বাঙালি, সেই একই আড্ডা, একই হা হা, এমন কি মেলার খাবারের দোকানগুলাও একই। যে কোনো খাবার চোখ বন্ধ করে খেয়েই বলে দেয়া যায়, অমুক ভাইয়ের রেস্টুরেন্টের খাবার।
সব ছাপিয়ে আবার শাড়ির চিন্তা ভর করে ওর ওপর। এক শাড়ি দিয়ে কোনোভাবেই তিনটা অনুষ্ঠান চালানো যাবে না। আজকের অনুষ্ঠানের জন্য জামা একটা ভালো বুদ্ধি হতে পারে। আজকে যেহেতু সকাল থেকে থাকা লাগবে। কারণ তার বাচ্চার আঁকাআঁকি প্রতিযোগীতা আছে। বিদ্রোহী গ্রুপটা খুব কায়দা করে জমায়েত বাড়াতে নানান ধরনের উদ্যোগ নিয়েছে; বাচ্চাদের আঁকা প্রতিযোগিতা, স্থানীয় নেতানেত্রীদের আনা, মেলার স্টলে কম টাকা দিয়ে দোকান দেয়া। সে এই সালোয়ারের সাথে সেই কামিজ আর সম্পুর্ণ ভিন্ন এক ওড়না দিয়ে সাদা লাল টাইপের একটা সেট বানিয়ে ফেলল। দশটার ভেতরে সে আর তার বাচ্চা পৌঁছে যায় অনুষ্ঠানে।
পৌঁছে দেখে শুধু আয়োজকেরা আর বারো-চৌদ্দ জন রাজনীতিবিদ; অস্ট্রেলিয়ান। এই বারো-চৌদ্দ জন অস্ট্রেলিয়ান খুব জরুরি। কারণ, এরাই অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন। নীলার মতো আর অল্প কিছু মা বাবা আছেন, যাদের বাচ্চারা পারফরমেন্স করবে সকালে। লম্বা সময়ের প্রোগ্রামে বাচ্চাদের আঁকাআঁকি, নাচ, গান শুরুতে, সকালের দিকে রাখা হয়। এইটাই নিয়ম। শিশুদের অধিকারও নিশ্চিত হয় আর সেই সাথে পিতামাতা জাতীয় অডিয়েন্সগুলাও বাধ্য হয় দর্শক সারিতে হাসি হাসি মুখে বসে থাকতে। দর্শকের আসন পুর্ণ হয়। দেখতে ভালো লাগে। তবে এরা দ্বিতীয় সারির পরের আসনগুলাতে বসে। প্রথম ও দ্বিতীয় সারি অস্ট্রেলিয়ান আর দেশীয় গুণীমান্যিদের জন্য। এইত গেল ব্যাকগ্রাউন্ডের আলাপ। রিসার্চার নীলা হয়ত এটাকে বলবে রিসার্চ সেটিং অথবা গল্পের কন্টেক্সট। সে যাই বলে বলুক।
নীলা যাকে নিয়ে আসলে আমাকে গল্পটা বলতে এসেছিল, তার পরিচয় দিল এতক্ষণ বাদে। ও যখন বিরস মুখে নিজের সাদামাটা সালোয়ার কামিজকে ঢাকতে ঢাকতে চার নইলে পাঁচ নাম্বার সারিতে বসে বাচ্চাদের আঁকা দেখছিল, ঠিক সেই সময়ই সেই মাঝবয়সী লোকটার দিকে চোখ পড়ে যায় ওর। মঞ্চের একপাশে বাচ্চারা আঁকছে, গান গাইছে এক আয়োজকের কিউটি পাই আর অস্ট্রেলিয়ান নেতানেত্রীগণ হাসি হাসি মুখে প্রথম দুই সারিতে বসে আছেন; অপেক্ষা করছেন বক্তৃতা দেবার। সেই মধ্যবয়সী বেচারা আচমকাই সিনে ঢুকে যায় ছয়টা পানির বোতল নিয়ে। গেস্টদের জন্য এগুলো যে বরাদ্দ তা তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু সে কাদের দিবে? বোতলের তুলনায় ভিআইপি বেশি। প্রথমেই লোকাল এমপি আর তার সাথের দু’জন পেল। তার ঠিক পাশেই দুই সম্মানিত দেশীয় আঙ্কেল বসে বসে বাচ্চাদের আঁকার বিচার করছিলেন। তারা যে মিনারেল ওয়াটার পাবেন না, সেটা নিশ্চিত ছিল নীলা। তারা হাসি হাসি মুখে পানিওয়ালার দিকে তাকালেন। পানিওয়ালাও হাসি হাসি মুখে তাদের ইগনোর করলেন। ‘গ্রিন পার্টির তিনজন নিয়েও আমার সন্দেহ ছিল’, হাসি চাপাতে চাপাতে বলল নীলা। ‘এরা দেশের বামদের মতো। এদের পাত্তা না দিলেও চলে। বরং স্থানীয় সরকারের দুই চার জন হোমরা চোমরা এসেছে; তাদের দিকে পানি ওয়ালা বেচারা এগিয়ে গেল।’ কিন্তু তার হিসাব গন্ডগোল করে দিয়ে মাঝখান থেকে এক সাদা ভদ্রমহিলা হাসি হাসি মুখে হাত বাড়ালেন।
হাতের দুইখানা বোতল দুইজন হোমরাকে দিতে দিতে পানিওয়ালা বেচারা হাসতে হাসতে বাকিদের আশ্বস্ত করলেন, ‘নো ওরিস্, ‘নো ওরিস্, আই উইল ব্রিং মোর ওয়াটার।’ এইবার আরও চার বোতল সমেত স্টেইজের ম্যালা দূর থেকেই টার্গেট ঠিক করে আসছেন উনি। গ্রিন পার্টি এতক্ষণে হায়ারার্কির বিষয়টা বুঝে গেছে। উনাদের মধ্যে যিনি নিপাট ভদ্রলোক, তিনি আগে থেকেই একটা বোতল বের করে, হাসি মুখে পানিওয়ালা ভাইয়ের দিকে উচু করে ধরলেন, ‘নো ওরিস্, নো ওরিস্, আই গট মাই ওউন বটল।’
পানিওয়ালা ভাই হাসি হাসি মুখ আরও বিস্তৃত করলেন। আর যেই আপাটা একটু পর জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন, তিনি অধিকার সচেতন হয়ে চোখেমুখে এমন একটা ভঙ্গী ফুটিয়ে তুললেন, তাকে একটা বোতল দেয়াই লাগল।
রইল বাকি তিন। পানিওয়ালা ভাইয়ের হিসাব ক্লিয়ার এইবার। সরাসরি গভর্নমেন্টের লোকগুলার ওইখানে চলে গেল। দেশীয় দু’জন এইবারও হাসি হাসি মুখে তাকালেন। কিন্তু পাল্টা কেউ তাকালও না তাদের দিকে। পানিওয়ালা বেচারা বিজয়ীর বেশে ব্যাক স্টেজে ফিরে যাচ্ছে এবার! আয়োজকদের একজন তার কাঁধে আলতো চাপড় দিলেন। দিয়ে প্রশংসা করলেন আর আস্বস্ত করলেন হাসি দিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে, পরেরবারের আয়োজনে তার ‘পানিওয়ালা’ রোল কনফার্ম।
‘ও’! নীলার গল্প প্রায় শেষের দিকে। গল্পের মোরাল বলার জন্য এখন সে আড়মোড়া ভাঙছে। আমিও চট করে কিছু একটা আন্দাজ করলাম; হাসি হাসি মুখে বললাম, ‘বেচারার পাঞ্জাবিটা এক্কেবারে পয়লা বৈশাখের জন্য পারর্ফেক্ট ছিল, তাই না? অনেক দামী ছিল?’
নীলা হো হো করে হেসে দিল। হাসি থামাতে থামাতেই বলল, ‘তারমানে, পরের লাইন তো বুঝতেই পারছ?
নিজের জোড়াতালির জামা নিয়ে লজ্জা লজ্জা ভাব সহসাই কেটে গেল আমার।’❐
লেখক: পিএইচডি গবেষক, কুইন্সল্যান্ড প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ব্রিসবেন, কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া