নারী: আরেকটু হলেই তো পাহাড়ের এই চূড়া থেকে পড়ে যেতেন! এভাবে কেউ পাহাড়ের খাদের দিকে এগিয়ে যায়? আরেক পা এগুলেই তো কয়েক হাজার ফুট নিচে পড়ে যেতেন! আপনি অন্ধ নাকি! আশ্চর্য তো!
পুরুষ: আমার দৃষ্টিশক্তি নেই সত্যি, তবে অন্ধ নই।
নারী: আচ্ছা, সরি! আমি বুঝতে পারি নি যে, আপনি অন্ধ!
পুরুষ: বললাম তো, আমি অন্ধ নই! শুধু চোখে দেখতে পাই না।
নারী: এ আবার কেমন কথা! আপনি তো বেশ হেঁয়ালী করতে পারেন!
পুরুষ: হেয়ালী! তা আমার সঙ্গে বিধাতা করছেন বৈকি! এই যে ধরুন, আপনি হচ্ছেন শ্রাবন্তী, এখন যদি আপনাকে এই নামে ডাকি, আপনি বলবেন, এটা আপনার নাম নয়।
নারী: হা হা হা, হাসালেন আমাকে। এটা সত্যিই আমার নাম নয়! আসলেই কি আপনি অন্ধ? নাকি মিথ্যে কথা বলছেন?
পুরুষ: সত্যি-মিথ্যে নিয়ে সেই কবে থেকে আমি হাতরে বেড়াচ্ছি কয়েকটি প্রশ্ন! আলো ঘেঁটে অন্ধকারের স্বরূপ খোঁজার মতো! আপনাকে কিছু কথা বলতে হচ্ছে, শুনবেন মনযোগ দিয়ে, প্লিজ! শ্রাবন্তী আপনি যা মিথ্যে বলে জানবেন, সেটা আসলে মিথ্যে নয়-মিথ। যা রহস্যের মধ্যে রয়েছে।
নারী: কি যে বলছেন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। আপনি আসলে..!
পুরুষ: আমি আসলে গল্পের মিথ থেকে বেরিয়ে আসা এক ধ্রুব সত্য!
নারী: সত্য যখন আছে, তাহলে মিথ্যেও আছে বা ছিল।
পুরুষ: মিথ্যে ছিল কিনা জানি না, তবে ভ্রম ছিল। জানেন, যে ভুলের জৌলুস তীব্র হয়, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হয় না, ও রকম ভুলের সামনে আমি হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিলাম একদিন! সেই আমি এখন কিন্তু ভুল বা বিভ্রমে নেই। শুধু চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেছি, এই যা!
নারী: কি সব বলছেন আপনি! আমি আপনার কোনো কথাই বুঝতে পারছি না! কে আপনি? আমাকে শ্রাবন্তীই বা বলছেন কেন?
পুরুষ: আপনি যে শ্রাবন্তী, তাই। আমার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে আপনাকে ঠিকই দেখতে পাচ্ছি আমি।
নারী: বুঝেছি, আপনার মধ্যে হেলুসিনেশন সৃষ্টি হয়েছে। বা রহস্যজনক ঘোরের মধ্যে ডুবে আছেন আপনি। এই ঘোরের কারণেই আপনি পাহাড়েরর চূড়া থেকে পড়ে যাচ্ছিলেন গহীন খাদে। তা আপনার সঙ্গে কি আর কেউ নেই? নিজেকে অন্ধ বলছেন, তো একা এই পাহাড়ের চূড়ায় কিভাবে এলেন?
পুরুষ: দৃশ্যমানে আমি একা হলেও কিন্তু একা নই। শ্রাবন্তী আমার পাশে আছে। অনেকক্ষণ ধরে তো ওর সঙ্গেই কথা বলছিলাম। আপনাকে দেখে ও বলে গেল-তোমার শ্রাবন্তী এসে গেছে। এবার আমি যাই।
নারী: হা হা হা। আশ্চর্য কথা!
পুরুষ: আশ্চর্য ঘটনাও! শ্রাবন্তী আমার সামনে! স্বীকার করছি, এমন ঘটনা জগত সংসারের কাছে আশ্চর্য ঘটনা বলেই বিবেচিত।
নারী: হা হা হা। ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন, আমি নীলাঞ্জনা, শ্রাবন্তী নই। আপনি সেই থেকে ভুল বকছেন!
পুরুষ: ভুল বকছি না। আপনি নীলাঞ্জনা ছিলেন বা সকলের কাছে এই নামেই আছেন, থাকবেন। কিন্তু আজ থেকে আপনি শ্রাবন্তী।
নারী: কেন? এটা আপনার কল্পনা বুঝি?
পুরুষ: না, কল্পনা নয়। এ এক অপার রহস্য। রহস্যময় সত্যও বলতে পারেন।
নারী: বুঝেছি, আপনার স্মৃতি বিভ্রম ঘটেছে। অথবা আপনি প্রলাপ বকতে খুব পছন্দ করেন।
পুরুষ: প্রলাপ! আপনি সত্যকে প্রলাপ বলছেন? তাহলে দু’একটি প্রশ্ন করি? সঠিক জবাব দেবেন?
নারী: করুন। কি জানতে চান, বলুন।
পুরুষ: আপনার বয়স যখন ৭ বা ৮ হবে, আপনি নন্দনপুরের বিলে গিয়েছিলেন। ওখানে নৌকায় চড়ে বেড়াচ্ছিলেন। কত পদ্মফুল ছিল বিলের জলে। আপনি যখন পদ্মফুল তুলতে গেলেন, তখন আকস্মিক পড়ে গেলেন জলে। মনে আছে?
নারী: আশ্চর্য! আপনি এ কথা কী করে জানেন?
পুরুষ: আপনি সেদিন বিলের জলে ডুবে যাচ্ছিলেন যখন, তখন একদল রঙিন মাছ আপনার কাছে এসে অন্যরকম গান গেয়েছিল। যে গান জন্ম থেকে জন্মান্তরের মেলবন্ধন তৈরির মন্ত্রণা শেখায়, সেই গান! মনে আছে?
নারী: আমাকে এভাবে চমকে দিচ্ছেন কেন? কে আপনি!
পুরুষ: আমি কিন্তু সেদিনও ছিলাম ওই মাছগুলোর সঙ্গে। মাছ নয়, ওরা ছিল জলপরী। আপনার মনে পড়ছে?
নারী: আমি সেদিন জলের অতলে ডুবে যেতে যেতে বাঁচার চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। আমার সামনে কে ছিল, কী ছিল-তা তো জানি না। শুধু জানি, বিলের এক জেলে জাল ফেলে আমাকে জল থেকে তুলে এনেছিল।
পুরুষ: সেদিন জলপরীদের মন্ত্রণায় আপনি বেঁচে ছিলেন!
নারী: না, না। আমাকে ওই জেলে জাল ফেলে তুলে এনেছিল। আমার স্পষ্ট মনে আছে সেই ঘটনা।
পুরুষ: দৃশ্যমানে তাই ছিল বৈকি। কিন্তু ঘটনার আড়ালে রহস্যও ছিল। সেদিন আপনার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার সময় আমার নিঃশ্বাসের গভীর আচ্ছন্নতা আপনাকে জড়িয়েছিল। আপনার অস্তিত্বের সঙ্গে আমার অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে যে!
নারী: আর কি প্রশ্ন আপনার? বলুন তো শুনি!
পুরুষ: আপনি যখন নবম শ্রেণীতে পড়ছেন, তখন প্রথম প্রেমপত্র পান পাশের বাড়ির এক কিশোরের কাছ থেকে। এরপর বিভিন্ন সময়ে বেশ কয়েকটি প্রেমপত্র পান অজ্ঞাত প্রেমিকদের কাছ থেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরুনো অব্দি আপনি একশ’ ষোলটি প্রেমপত্র পেয়েছেন। বিভিন্ন সময়ে সরাসরি প্রেমের প্রস্তাব পেয়েছেন সতেরবার। আপনার বিয়ের কথাবার্র্তা হয়েছে বারোবার। এ পর্যন্ত চারজন পাত্র দেখেছে আপনাকে। গত মাসেও একজন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী পাত্র দেখেছেন আপনাকে। আপনিও তার সঙ্গে আলাদাভাবে দেখা করে কথা বলেছেন। বিয়ের দিন-তারিখ প্রায় ঠিক হয়েছিল। আকস্মিকভাবে পাত্রপক্ষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলল। বিয়ে আপাতত হচ্ছে না। তাই না? কথা বলছেন না যে! চুপ করে আছেন কেন? বলুন, আমি কি মিথ্যে বলছি? এই যে শ্রাবন্তী, আমার কথা শুনছেন!
নারী: হ্যাঁ, শুনছি!
পুরুষ: আপনি কাঁদছেন! আমি কি আপনাকে কাঁদিয়ে দিলাম? কাঁদবেন না, প্লিজ! আপনার চোখের জল অনেক, অ-নে-ক পবিত্র, জানেন! শুধু আমি জানি, আপনার চোখের জলের কী পবিত্রতা! আপনার চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লে ধরায় সেকী তোলপাড় হয়! কোথাও ভূমিকম্প হয়ে যায়! সমুদ্রের তলদেশে সুনামি ফুঁসে ওঠে! আপনি কাঁদবেন না, প্লিজ! আপনি বেশিক্ষণ কাঁদলে পৃথিবীতে বসন্ত নাও আসতে পারে! শ্রাবন্তী..!
নারী: থামুন! চুপ করুন! কে আপনি, বলুন তো! আপনি কি সত্যিই অন্ধ? আমার জীবনের এতো কথা আপনি জানেন কী করে! কে আপনি, বলুন!
পুরুষ: আমার একটা নাম আছে। এই নামে আমাকে চিনবেন না। তবু নামটা বলছি। আমার নাম আনন্দ। নাম আনন্দ হলেও আমার জীবনটা বিষাদময় এক আখ্যান!
নারী: আনন্দ নামে আমি কাউকে চিনি না, চিনতামও না। আপনাকে আমি এর আগে কোনদিন দেখিনি!
পুরুষ: তা সত্যি নয়! আমাকে আপনি চিনতেন। আমরা যে জীবন এখন বয়ে বেড়াচ্ছি, এই জীবনে আপনি নীলঞ্জনা। আর আমি আকাশ। আমাদের আরেকটি জীবন ছিল, সেই জীবনের কথাই আমি বলছি!
নারী: বাহ, বেশ! আমাদের আরেকটি জীবন ছিল, সেই জীবনের কথা আপনার মনে আছে, শুধু আমার মনে নেই! এমন উদ্ভত কথা কেউ বিশ্বাস করবে? আমার জীবনের দু’একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা বলে ফেলতে পেরেছেন বলেই-আপনি যে আষাঢ়ে গল্প বলবেন-তাই আমাকে বিশ্বাস করতে হবে?’
পুরুষ: জোর করে বিশ্বাস করতে হবে না। আমার কথাগুলো এই মুহুর্তে অবিশ্বাস্য মনে হলেও কাল থেকে তা সত্যি মনে হবে।
নারী: হা হা হা। হাসালেন আপনি! হাসতেও কষ্ট হচ্ছে আমার। কাল থেকে কেন আপনার প্রলাপ আমার কাছে সত্য বলে মনে হবে?
পুরুষ: বলছি, শুনুন। আজ রাতে আপনি স্বপ্ন দেখবেন। আমি যা বলেছি, তাই স্বপ্নে দেখতে পাবেন আপনি। আরো বেশি কিছু দেখতে পাবেন। আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় এবং প্রেম কীভাবে হয়েছিল, জানতে পারবেন। কিভাবে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়েছিলাম এবং কেন হয়েছিলাম, সেটাও জানবেন। কেন আমরা জন্ম-জন্মান্তরের বন্ধনে আবদ্ধ-তাও দেখতে পারবেন স্বপ্নে।
নারী: আমি হাসবো, না কাঁদব, বুঝতে পারছি না!
পুরুষ: স্বপ্নে আপনি আপনার ফেলে আসা জীবনের ঘটনাগুলো দেখতে পাবেন। এরপর যখন আপনার ঘুম ভাঙবে, আপনি ছটফট করতে থাকবেন। অনেক কষ্ট অনুভব করবেন আমার জন্য। ছুটে আসবেন আমার কাছে। যা বলছি, তা সত্যি হবে, জেনে রাখুন!’
নারী: তা কোথায় ছুটে আসব? আমি তো আপনার ঠিকানা জানি না। কীভাবে আপনাকে খুঁজে পাবো, বলুন তো!’
পুরুষ: কাল আমার চোখের অপারেশন হবে এই শহরের একটি হাসপাতালে। আশা করছি, আমি ফের দেখতে পাবো। দু’তিন পর আমার দৃৃষ্টিশক্তি ফেরত আসবে। আমি আশা করব, চোখ খুলে আমি আপনাকে দেখতে পাব। নীলাঞ্জনা নয়, আমার শ্রাবন্তীকে দেখতে চাই আমি। নইলে দৃৃষ্টি ফিরে পেয়ে কী লাভ!
নারী: স্বীকার করছি, আজ আমাকে চমকে দিয়েছেন আপনি। এই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আকাশ-বাতাসকে সাক্ষী রেখে বলছি, যদি সত্যি সত্যি স্বপ্ন দেখি এবং সেই স্বপ্নে আপনার কথাগুলো সত্য হয়, আমি ছুটে আসবো আপনার কাছে। আমি নীলাঞ্জনা হলেও আপনার শ্রাবন্তী হয়ে যাব।’
পুরুষ: আমি জানি, তাই হবে। কারণ, কাল রাতে আমিও স্বপ্নে দেখেছিলাম, এই ঘটনা। স্বপ্নে দেখেছিলাম, আগের জীবনের শ্রাবন্তীর সঙ্গে পাহাড় চূড়ায় এভাবেই আমার দেখা হবে, কথা হবে।
নারী: আমাকে এবার যেতে হচ্ছে। যাই।
পুরুষ: ফের দেখা হবে- এটাই বলছে মন।
নারী: চোখ খোল, দেখো-তোমার শ্রাবন্তীকে!
পুরুষ: তাহলে সত্যিসত্যি এসেছ? স্বপ্ন দেখেছিলে?
নারী: স্বপ্ন নয়, নিজের আগের জীবনকে দেখেছিলাম। তোমার কথাই ঠিক, আমরা গল্পের কোনো মিথ হতে পারি নি বলে পুনরায় জীবনের কাছে ফিরে এসেছি। জীবনের মধ্যে যে অসম্পূর্ণতা রেখে গিয়েছিলাম, তার পরিপূর্ণতা আমরা চেয়েছিলাম সর্বান্তকরণে। তাই না?’
পুরুষ: আমাদের চাওয়াটা তুচ্ছ। আমরা পুনর্জন্মে ফিরেছি নিজেদের চাওয়ার জন্য নয়, প্রেমের জন্যই আমরা ফিরতে পেরেছি।
নারী: প্রেম! প্রেম এতটা শক্তি রাখে?
পুরুষ: রাখে। প্রেম জন্ম-জন্মান্তরের অপার্থিব বন্ধন। প্রেমই ঈশ্বর স্রষ্টা। স্রষ্টাই প্রেম। এই প্রেম নিয়ে আমি চোখ খুলছি। শ্রাবন্তী, আমি চোখ খুলে তোমাকে প্রাণভরে দেখতে চাই! তুমি ফের কাঁদছ?
নারী: প্রেম, শুধু স্রষ্টাই নয়, চোখের জলও, তাই কাঁদছি! এ কান্নায় বসন্তের অভিমান হয় না!
দর্পণ কবীর একজন প্রেমের কবি। তার অধিকাংশ কবিতার উপজীব্য বিষয়- প্রেম। জন্ম বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ শহরে। ছড়া ও কবিতা লেখা দিয়ে সাহিত্যচর্চার শুরু। এরপর গল্প, উপন্যাস ও গান লিখে চলেছেন। ১৯৯১ সালে তার প্রথম ছড়ার বই ‘ধপাস’ প্রকাশিত হয়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘কষ্টের ধারাপাত’ প্রকাশিত হয় ২০০০ সালে। এরপর ক্রমান্বয়ে কাব্যগ্রন্থ ‘আকাশ আয়না’ (২০১২), ‘বসন্ত নয় অবহেলা’ (২০১৬), ‘গল্পটার নাম নেই’ (২০২০), ‘আশ্চর্য দুঃখগুলো কষ্ট হয়নি’ (২০২২) প্রকাশিত হয়।
বর্তমানে দর্পণ কবীর সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে বসবাস করছেন। পেশায় তিনি একজন সাংবাদিক।