সবে বসন্তোৎসব গেল। দোল, আবির, পলাশ, দক্ষিণ সমীরণ, সঙ্গে অনেকটা আলো আর কিছুটা অন্ধকার। নতুন কিছু নয়, আলো থাকলে অন্ধকার ও থাকবে, চিরাচরিত ব্যবস্থা। তবে কখন কখন আলো- অন্ধকারের মাত্রাটা বাড়ে কমে, এবারে হয়ত অন্ধকার কিছুটা বেশি। রাজনৈতিক, সামাজিক, দৈনন্দিন জীবনে, অসুখে- বিসুখে, বিশ্বাসভঙ্গে, মনোমালিন্যে। কিন্তু তাতে কি-ই বা এলো গেল! দুঃখ তো থাকবেই। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো বারেবারে ফিরেও আসবে। তার মধ্যেই টুকরো টুকরো আনন্দও থাকবে। ওই সব টুকরোগুলো কুড়িয়ে বাড়িয়েই তো আমাদের বেঁচে থাকা। অতএব বসন্ত যাই যাই করলেও কিচ্ছু এসে যায় না। সামনেই পয়লা বৈশাখ।
নারকেলের নাড়ু, খইয়ের মোয়া, নতুন জামা, কালবৈশাখী, বৃষ্টির গন্ধ, চড়কের ভাঙ্গামেলা- সব নিয়ে পয়লা বৈশাখ ছিল হিন্দু- মুসলমানের মিলিত উৎসব। আজও এপার ওপার দুই বাংলাতেই তার সমান অধিকার। তবে শুধু বঙ্গদেশই নয়, তামিলাড়–, ওড়িশা,অসম, এমনকী ব্রহ্মদেশ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ডেও, অর্থাৎ যেখানে যেখানেই ধান ও রবিশস্যের চাষ হয় সেখানেই এই সময়ে নতুন বছরের উৎসব। হয়ত দিন তারিখের একটু অদলবদল হয়, ওইটুকুই যা আলাদা। এখানে একটা বিষয় লক্ষ্যণীয়, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার যে দেশগুলোতে পয়লা বৈশাখ নববর্ষ – থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার এরা প্রত্যেকেই থেরবাদী বৌদ্ধ প্রধান দেশ। যদিও এর সঙ্গে বৈশাখী পূর্ণিমার অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধের জন্ম ও নির্বাণ তিথির কোনো যোগ আছে কিনা তা জানা নেই, তবে এই দিনটির সঙ্গে একটি ব্রাহ্মণ্য যোগসূত্র আছে। তা হলো বরাহমিহির রচিত ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’। ৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে আচার্য বরাহমিহির ‘পঞ্চ সিদ্ধান্তিকা’ নামের একটি গ্রন্থ রচনা করেন। এই গ্রন্তটিকে জ্যোতিষ শাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিজ্ঞানের সংক্ষিপ্ত সার বলা যায়। এর পাঁচটি খণ্ড। সূর্য সিদ্ধান্ত, রোমক সিদ্ধান্ত, বশিষ্ঠ সিদ্ধান্ত, পৌলিস সিদ্ধান্ত এবং পৈতামহ সিদ্ধান্ত। এর মধ্যে সূর্য সিদ্ধান্ত হলো থেরবাদী দেশগুলোর ক্যালেন্ডারের ভিত্তি। আমাদের বাংলা পঞ্জিকার ভিত্তিও একই। সম্রাট অশোকের সময় বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারের সুবাদে, এবং পরবর্তী সময়ে পল্লব রাজাদের মাধ্যমে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার হয়। তাছাড়া এই ভ‚খণ্ডের সঙ্গে একটা বাণিজ্যিক সম্পপর্ক তো ভারতের ছিলই। ফলে সূর্য সিদ্ধান্তের সঙ্গে এই যোগাযোগটা আশ্চর্য নয়।
বঙ্গাব্দ শব্দটা শুনলেই মনে হয়, বঙ্গদেশের নিজস্ব। এর সূচনা সম্পর্কে দু’টি মত আছে। একদল ঐতিহাসিক মনে করেন গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক (৫৯০/৬০০ – ৬২৫/৬৩৬ খ্রিস্টাব্দ) বঙ্গাব্দের সূচনা করেছিলেন। দ্বিতীয় মত অনুসারে ইসলামি শাসনকালে হিজরী পঞ্জিকা অনুযায়ী সকল কাজকর্ম পরিচালিত হত। মূল হিজরী পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের ওপর নির্ভরশীল। চন্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চেয়ে ১১/১২দিন কম। এ কারণে চন্দ্র বৎসরে ঋতুগুলো একটু হেরফের হয়ে যেত। অথচ বঙ্গদেশে চাষ আবাদ মূলত ঋতু নির্ভর। তাই মুঘল সম্রাট আকবর যখন ১৫৮২/৮৪ খ্রিস্টাব্দে দীন-ই-ইলাহি ধর্মের প্রচলন করেন তখন সেই একই বছরে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেউল্লাহ শিরাজির সাহায্যে ইসলামি চান্দ্রবর্ষ এবং হিন্দুদের সৌরবর্ষের সংযোগে নতুন ফসলি সনের সূচনা করেন। কেউ কেউ মনে করেন এইভাবেই বাংলার নববর্ষের শুরু। তবে শামসুজ্জামান খান এবং নীতিশ সেনগুপ্তের মতে বাংলা বর্ষপঞ্জীর উৎপত্তি নিয়ে অনেক অস্পষ্টতা আছে।
সূচনা যেভাবেই হোক নববর্ষ উদযাপনে কিন্তু সাধারণের কোনো দোলাচল কোনোদিনই ছিল না। তবে আধুনিকভাবে নববর্ষ উদযাপন কিন্তু শুরু হয় অনেক পরে, ১৯১৭ সালে, যদিও বাংলা সংস্কৃতিতে বাংলা সনের ব্যবহার এখন আর আগের মতো নেই। এখন শুধু কৃষিক্ষেত্রে বীজতলা নির্মাণ বা ফসল তোলার কাজেই বাংলা মাসের ব্যবহার। ষাট/সত্তরের দশকেও যে হালখাতার উৎসব হতো এখন তা অনেক ফিকে হয়ে গেছে। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন কলকাতার কলেজ স্ট্রীট বই পাড়ার অনেক ব্যবসায়ী – কাগজওয়ালা, প্রকাশক, পুস্তক বিক্রেতারা পয়লা বৈশাখে নতুন হিসেবের খাতা শুরু করতেন। বর্ষীয়ান লেখক সবিতেন্দ্রনাথ রায় মহাশয়ের স্মৃতি কথা থেকে জানতে পারি সে সময় ভোলানাথ দত্ত এবং রঘুনাথ দত্ত দুই বড় কাগজ ব্যবসায়ী ছিলেন অধিকাংশ প্রকাশকের কাগজের জোগানদার। আর একজন ছিলেন পি. সি. কুণ্ডু। ওদিকে চীনাবাজার অঞ্চলে কিছু কাগজ ব্যবসায়ী ছিলেন যারা টিটাগড় পেপার মিল, ইন্ডিয়ান পেপার পাল্প বা বেঙ্গল পেপার মিলের কাগজ ছাড়াও বিদেশ থেকে কাগজ নিয়ে আসতেন। ইটালিয়ান আর্ট পেপার বা জার্মান প্রোভেন আর্ট, আর্ট বোর্ড এরাই প্রথম বাজারে নিয়ে আসেন।
রায় মহাশয় আরও লিখেছেন, হালখাতার সময় ভোলানাথ এবং রঘুনাথের বাড়িতে ভিয়েন বসত। ঠাকুর এসে রান্নার আয়োজন করতেন। যারা কাগজের দেনদার তারা ওইদিন টাকা পরিশোধ করতেন এবং তাদের বসিয়ে খাওয়ানো হতো। আর বই পাড়ার কোনো দোকান থেকেই সেদিন লেখক, ক্রেতা, বিক্রেতা কাউকেই খালি হাতে, খালি মুখে ফিরতে হতো না।
এখন সেই পুরনো হিসেব নিকেশ বদলেছে। কালের নিয়মে সেটাই হয়ত স্বাভাবিক। কিন্তু ‘পয়লা বৈশাখ’ শব্দটার মাদকতা বাঙালির কাছে এখনও একই রকম, বৈশাখী পূর্ণিমার চাঁদ আর এক আকাশ ভর্তি নক্ষত্রের আলো যেমন কোনোদিনই পুরনো হয় না।
লেখক: কলামিস্ট, কলকাতা, ভারত থেকে
3 Comments
Zaman Khaleq
এত বিস্তারিত আগে কখনও পড়িনি। সেদিক থেকে অলি সেনের এ লেখাটি অনন্য বলা যায়। অলির সকল লেখায় গতানুগতিকতার বাইরে। তাই তার লেখা জানার পরিধিকে সমৃদ্ধ করে।
রবীন বসু
সুন্দর স্মৃতিঘন লেখা। অভিনন্দন জানাই।🙏
Shaibal Nandi
খুব সুন্দর।