২৫ মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনে বেদনাবহ দিন। একাত্তরের এই রাতে ঘুমিয়ে থাকা নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ট্যাঙ্ক-কামান-মেশিনগান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারা চেয়েছিল বাঙালি জাতিকে চিরদিনের মতো স্তব্ধ করে দিতে। ঘুমন্ত মানুষ কিছু বুঝে ওঠার আগেই লাশে পরিণত হতে থাকে। জীবিতরা যে যেভাবে পারে ঢাকা শহর ছাড়তে শুরু করে। শিশু, নারী, পুরুষের ঢাকা ছাড়ার ওই দৃশ্য নতুন প্রজন্মকে শুধু বলে বা লিখে বোঝানো কঠিন। অবশ্য বীর বাঙালি রুখে দাঁড়াতেও সময় নেয়নি। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল তারা। অনভ্যস্ত হাতেই তুলে নিয়েছিল অস্ত্র।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ যে অপারেশনে নামে পাকিস্তানি বাহিনী, তার আনুষ্ঠানিক নাম ‘অপারেশন সার্চলাইট’। একই সঙ্গে শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার প্রথম প্রহর। অপারেশনটির আসল উদ্দেশ্য ছিল ২৬ মার্চের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) মতো বড় বড় শহর দখল করে নেওয়া এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ দমন করা। কিন্তু বাঙালিরা যে পাল্টা প্রতিরোধ সৃষ্টি করবে, পাকিস্তানি পরিকল্পনাকারীরা সেটা ধারণাও করতে পারেনি। পাকিস্তান সেনা, বিমান ও সেনৗবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের বড় অংশ বিদ্রোহ ঘোষণা করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা, যার বার্তা নতুন এই দেশের আনাচে-কানাচে এবং বিশ্বের সর্বত্র দ্রুত পৌঁছে যায়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কোনো অবস্থাতেই বাঙালিদের স্বার্থের কোনো দলকে ক্ষমতায় দেখতে চাননি। কিন্তু ১৯৭০-এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করল আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানি শাসকরা শুরু করল ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র। জুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং জেনারেল হামিদ মনে করেছিলেন, কয়েক হাজার মানুষ হত্যা করলেই ভয় পাবে বাঙালিরা। সরে আসবে স্বাধীনতার দাবি থেকে। অপারেশন সার্চলাইট সফল করার জন্য ছিল সাতটি নির্দেশ। বলা হয়েছে, সারাদেশে একযোগে পরিচালিত হবে এ হামলা। দুটি কমান্ড ছিল অপারেশন সার্চলাইট পরিচালনার জন্য। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ছিলেন ঢাকা শহরের অপারেশনের দায়িত্বে। তার অধীনে ব্রিগেডিয়ার জেহানজেব আরবাব ও তার ৫৭ পদাতিক ডিভিশন দায়িত্ব পায় হত্যাযজ্ঞ পরিচালনার। মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজার ওপর দায়িত্ব ছিল দেশের অন্য অঞ্চলগুলোয় গণহত্যার। এই রাও ফরমান আলীই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনিই শান্তি কমিটি ও আলবদর বাহিনী গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অপারেশন সার্চলাইট দলিলটির দিকে মনোযোগ দিলেই বোঝা যাবে, এটি কোনো সামরিক অভিযানের দলিল নয়, বরং একটি বিশাল জনগোষ্ঠীকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। ইয়াহিয়া খান ও তার জেনারেলরা ২৫ মার্চের অনেক আগে থেকেই এ ধরনের সামরিক অভিযান পরিচালনার কথা ভাবছিলেন।
বেসামরিক মানুষের বিরুদ্ধে হত্যাযজ্ঞ চালানোর বিষয়ে ভিন্নমতের কারণে পদত্যাগ করেছিলেন ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খান। ২২ ফেব্রুয়ারি ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া খান বিভিন্ন প্রদেশের কমান্ডারদের সঙ্গে যে বৈঠক করেন, তাতেই এই সামরিক অভিযানের অনুমোদন দেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন জেনারেল নিয়াজি। অথচ মার্চ মাসেই ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার প্রহসন চালিয়ে গেছেন ইয়াহিয়া খান!
অপারেশন সার্চলাইটের মূল পরিকল্পনাকারী কে? রাও ফরমান আলী এই পরিকল্পনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। তিনি দায় চাপিয়ে বলছেন, জিওসি মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা এর মূল পরিকল্পনাকারী। কিন্তু দু’জনের মনেই নাকি সামরিক অভিযানেরব্যাপারে ছিল সংশয়। তাই পিন্ডি থেকে তাদের সাহায্য করার জন্য পাঠানো হলো মেজর জেনারেল মিঠঠা ও মেজর জেনারেল জানজুয়াকে। সার্বিক পরিকল্পনা অনুমোদন করেছিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান। ২৫ মার্চ রাতে শুরু হলো ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়ন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বাঙালিবিদ্বেষ যে কতটা গভীরে তা বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল। একইসঙ্গে তারা নিশ্চিত হলো বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের যথার্থতা বিষয়ে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে পাকিস্তান সরকার একটি কমিশন গঠন করেছিল। ‘হামুদুর রহমানকমিশন’ নামে পরিচিত ওই কমিশনের রিপোর্ট সরকারিভাবে আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু রিপোর্টের অনেক তথ্যই এখন জানা যায়। তাতে ‘অপারেশনসার্চলাইট’ নামের গণহত্যার ষড়যন্ত্রের জন্য প্রধানত জুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল ইয়াহিয়া, জেনারেল হামিদ ও টিক্কা খানকে দায়ী করা হয়। আর তদন্ত রিপোর্টে নয় মাসের গণহত্যার কথা উল্লেখ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে যারা যুদ্ধাপরাধে জড়িত, তাদের বিচারের আওতায় আনার সুপারিশ করা হয়েছিল।
একাত্তরের ২৫ মার্চ ক্যালেন্ডারের পাতায় কেবলই একটি তারিখ হতে পারে, কিন্তু বাঙালি জাতির কাছে এই তারিখটির মূল্য অনেক। শুধু বাঙালি নয়, বিশ্বের বিবেকবান সব মানুষের কাছেই এই তারিখটি আলাদা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। প্রতিটি জাতির জীবনে বিশেষ কিছু দিন থাকে, যে দিনগুলো সেই জাতিকে আলাদাভাবে বিশ্ববাসীর কাছে পরিচয় করিয়ে দেয়। ২৫ মার্চ আমাদের জাতীয় জীবনে সেই রকম একটি দিন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় বর্বরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর দিন এই ২৫ মার্চ। মুক্তির মন্দির সোপান তলে ২৫ মার্চের রাতে যারা প্রাণ বলিদান করেছেন তাদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। ২৫ মার্চে এই সত্যও পুনর্বার প্রমাণিত হয়েছিল, অস্ত্র দিয়ে গণতন্ত্রের পথ যেমন রুদ্ধ করা যায় না, তেমনি স্বাধীনতাকামী জাতিকে অস্ত্রের মুখে স্বাধীনতার আন্দোলন থেকে বিচ্যুত করা যায় না।
পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা গণহত্যা চালিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্পৃহা রোধ করতে পারেনি। তাদের যারা সহযোগিতা করেছিল স্বজাতদ্রোহী রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনীর সদস্য তাদের কারও কারও যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিচার হয়েছে এবং এখনও তা চলমান। ইতিমধ্যে কয়েকজন অপরাধীর চূড়ান্ত দণ্ডও কার্যকর হয়েছে। বাকি অভিযুক্তদের বিচারকার্য যাতে ত্বরিত সম্পন্ন হয় এটাই সময়ের দাবি। একাত্তরে বাঙালি রুখে দাঁড়িয়েছিল। এ প্রজন্মের সদস্যরাও দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছিল কাদের মোল্লার রায়ে কাঙ্ক্ষিত প্রতিফলন না দেখে। ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে প্রজন্ম জানিয়ে দিয়েছে, রক্তস্নাত এই বাংলাদেশে ওদের ক্ষমা নেই। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার জাতির দাবি ও প্রত্যাশা পূরণে অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে এবং এখনও তারা এ ব্যাপারে অটল। মুক্তিযুদ্ধের বহু স্বপ্ন এখনও অপূর্ণ। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সেসব স্বপ্ন বাস্তবায়নে এগিয়ে যেতে হবে।❐
লেখক: কথাসাহিত্যিক