ভেড়িবাধে দাঁড়িয়ে জলের দিকে মুখ করে একমনে চেয়ে আছে যমুনা। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী যে এত দেখছে তা সে নিজেও জানে না। বিকেলের রোদটা অবশ্য পড়ে আসতে শুরু করেছে এর মধ্যেই। বেশ একটা নরম কোমল ছোঁয়া এখন তার স্পর্শে। ভেড়ির জলে গুলে যাওয়া সেই রোদ বড় মায়াময় করে তুলেছে চারপাশ। জলের আয়নায় আকাশের ছবি বেশ স্পষ্ট। আর সেই ছবিতে আরও স্পষ্ট দিন শেষের ইশারা। হ্যাঁ, আরো একটা দিন শেষ হয়ে আসছে। একটু পরেই সাঁঝ নামবে। তারও পরে রাত্রি। আর রাত্রি মানেই ঘুটঘুটে আঁধার। চারপাশ ঢেকে যাবে সেই আঁধারে। এদিকে ইলেকট্রিকের আলো এখনো পৌঁছাতে পারে নি। আর পৌঁছলেই বা কী? এখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য ভেড়ি। মাঝেমধ্যে ছোটখাটো গ্রাম। আর সে সব গ্রামে গরীব গুর্বোদেরই বাস কেবল বলতে গেলে। খড়ের ছাউনি দেওয়া ঘর। মাটির বাড়ি। দু’টো একটা পাকা বাড়ি যে একেবারেই নেই, এমনটা নয়। আছে। তবে তার সংখ্যা নিতান্তই কম। এখানের হাওয়ায় ওড়ে খিদে আর মাছের গায়ের আঁশটে গন্ধ। এই গন্ধই বুক ভরে টেনে নেয় সবাই। যেমন টানছে যমুনা। যমুনা এখন যে ভেড়ি বাঁধে দাঁড়িয়ে আছে এটা মাধব মণ্ডলের। পাশাপাশি এমন আরও চার চারটে ভেড়ি আছে মণ্ডলের। সবগুলোই নোনাজলের ভেড়ি। ভেড়ির জলে দিন-রাত খেলে বেড়ায় নোনাজলের মাছ। একটু গায় গতরে হলেই ভেড়ির জল থেকে উঠে চলে যায় আড়তে। আড়ত থেকে বাজার। তারপর বাঙালির পাতে।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এসবই ভাবছে যমুনা। যমুনার সামনে ভেড়ির জল ছুঁয়ে বসে থাকা রোদ। পেছনে তার কুঁড়ে। এটা একান্তই তার নিজের। আবার যেন নিজের নয়। বাঁশ, খড়, মজুর লাগিয়ে মাধব মণ্ডলই মাথা গোঁজার আশ্রয় হিসেবে যমুনাকে বানিয়ে দিয়েছে এটা। বলেছে, ‘একা মানুষ,এর চে’ ভালো দিয়ে আর কী হবে। এতেই থাকো।’
খুশি হয়ে মাথা নেড়েছিল যমুনা, ‘আপনের দয়া বাবু।’
‘দয়া? কী জানি। হবে হয় তো। তবে হ্যাঁ, কাজ-টাজ ফেলে হঠাৎ করেই যেন আবার ডুব মেরো না।’
‘সেই সুযোগ কী আর ওর আছে বাবু।’
‘কথাটা বলেছিল হরিদাসী। এ কূল, ও কূল, সব কূল ভেসে গেলে ভাসতে ভাসতে হরিদাসীর কাছেই এসে উঠেছিল যমুনা। হরিদাসী তার মাসতুতো বোন। স্বামী-স্ত্রী দু’জনায় মিলে মাধব মণ্ডলের ভেড়িতে কাজ করে। পাঁচ পাঁচটা ভেড়ির মালিক মাধব মণ্ডল। নোনাজলে চিংড়ির চাষ করে। বাগদা, গলদা, চামনে। ভোর ভোর জল থেকে তুলে সে সব চিংড়ি ঝাড়াই বাছাই শেষে চলে যায় আড়তে। নারী পুরুষ মিলিয়ে বেশ ক’জন লোক নিত্যদিন কাজ করে মণ্ডলের ভেড়িতে। জল থেকে চিংড়িগুলো ওপরে উঠে এলে ঝড়ের বেগে হাত চালিয়ে সাইজ অনুযায়ী আলাদা করতে হয় সব। এক এক সাইজের এক এক দাম। সাইজে যত বড়, দামেও তত বেশি। ব্যাপারটা জানা ছিল বলে দু’মুঠো খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য হরিদাসীর কাছেই ঠাঁই নিতে ছুটে এসেছিল যমুনা। হরিদাসী বলেছিল, ‘তুই কী পারবি?’
মাথা নেড়েছিল যমুনা, ‘ঠিক পারবো।’
‘ভেব্যে দ্যাখ। পরে আবার ঝ্যান বলিস নি পারবো না। তাতে কিন্তুক মুখ থাকপে না আমার।’
‘না রে বুন, না। খিদের কাছে ‘পারব না’ চলে না। এই প্যাটে যে রাজ্যির খিদে আমার।’
যমুনাকে সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছিল হরিদাসী। মাধব মণ্ডল যমুনার সারা শরীরে বার কয় চোখ বুলিয়ে নিয়ে শেষে বলেছিল, ‘দেখে তো মনে হয় একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিলে ঠিকই পারবে। তা হ্যাঁ গো, তোমার বাড়ি কোথা? সংসারে আর কে কে আছে?’
উত্তর দিয়েছিল হরিদাসী, ‘ওর কেউ নাই বাবু। পিরানখালির নদীবাঁধে একদিন অবশ্য এট্টা ছোট্ট সোংসার ছেল ওর। স্বামী-ইস্তিরি নদীতি মাছ ধরতো। সেই মাছ বেচ্যেই চলতো এগের খাওয়া পরা। হাজারো কষ্টের মধ্যিও এক রকম সুখিই ছেল। কিন্তুক সেই সুখ এর কপালে সইলো নি। সাত দিনির জ্বরে ভুগ্যে ওর সোমত্থ পুরুষডা মারা যেতিই-’
এটুকু বলেই থেমেছিল হরিদাসী। মাধব মণ্ডল জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তা এবার থেকে কী তোমার বাড়িতেই থাকবে?’
এমনই একটা সুযোগ খুঁজছিল হরিদাসী। ঝপ করে পেড়েই ফেলেছিল কথাটা, ‘ভেড়িবাঁধে ওর জন্যি যদি এট্টা আচ্ছয় কইরে দেতেন বাবু। আমাগের নিজিগেরই থাকার জায়গা হয় না। তার ওপর যদি-‘
মাথা নেড়েছিল মণ্ডল, ‘আচ্ছা, বলছো যখন, দেখি। তাহলে এক কাজ করো মেয়ে, কাল থেকেই কাজ শুরু করে দাও।‘
দু’চোখ আচমকা উপচে ওঠা জলে ভিজে গিয়েছিল যমুনার। ঝম করে মণ্ডলের পা দু’খানি ধরে ফেলেছিল। মণ্ডল পা ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলেছিল, ‘করো কী? করো কী?’
হরিদাসী বলেছিল, ‘আপনে ওরে আচ্ছয় দেলেন বাবু। তাই-’
‘ও, এই কথা। তা এতে আবার পায়ে হাত দেওয়ার কী আছে। তুমি কাজ করবে, থাকবে। তবে হ্যাঁ, কাজে কিন্তু ফাঁকি দেওয়া চলবে না। এ ব্যাপারে আমি কিন্তু খুব কড়া। কথাটা মনে রেখো।’
মাথা নেড়েছিল যমুনা। অর্থাৎ সে মনে রাখবে।
সেই থেকে এই ভেড়িবাধেই আছে যমুনা। ছোট্ট দো চালা একখানি কুঁড়ে। সামনে আরও ছোট বারান্দা। দিনরাত সেখানে নোনা হাওয়া অবাধে খেলা করে। আঁচল বিছিয়ে শুয়ে থাকে আঁশটে গন্ধ। একাকীত্ব হামাগুড়ি দেয় ঘর বারান্দা জুড়ে। এ সব নিয়েই থাকে যমুনা। এটাই তার সংসার। তার বেঁচে থাকা। একটাই পেট। আগেপিছে ভাবনা নেই। মণ্ডলের কাজ করে যা রোজগার করে তাতে বেশ চলে যায়। শুধু যে মেছোভেড়ির কাজই করে যমুনা এমন নয়। মণ্ডলের বাড়িতে গিয়ে নিত্যদিন এটা ওটা করে দেয়। মণ্ডল গিন্নি খুশি হয়ে এটা ওটা দেয়। চাল, কলা, আলু, মুলো। ভেড়িবাধের বেশ খানিক জায়গা জুড়ে যমুনা সবজি লাগায়। নিজেরটা খেয়েও থেকে যায় আরও। বাড়তিটুকু দিয়ে আসে মণ্ডল গিন্নির হেঁসেলে। গিন্নি খুশি হয়। সেই খুশিতে আরও বেশি খুশি হয় মাধব মণ্ডল। রাত নামতেই সেই খুশি কয়েক গুন বেড়ে আছড়ে পড়ে মণ্ডলের সারা শরীরে। তার রক্তে আগুন জ্বলে ওঠে। যে আগুন নেভাতে তাকে যমুনার কাছেই যেতে হয়।
প্রথম দিন অবশ্য খুবই আপত্তি করেছিল যমুনা। মণ্ডলের হাতে পায়ে ধরে বলেছিল, ‘আমার অমন সব্বোনাশ করবেন নি বাবু।’
কে শোনে কার কথা। মাধব মণ্ডলের মুখে তখন বাংলা মদের গন্ধে ভুরভুর। চোখে ভাটার আগুন। রক্তে সেই আগুনের ছোঁয়া। যমুনার মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেছিল, ‘চুপ কর যমনা। সর্বোনাশ? কীসের সর্বোনাশ? আমি তোকে কাজ দিয়েছি। থাকতে ঘর দিয়েছি। খিদে নিবারণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি। এত কিছু করে দিয়েছি তোর জন্যে আর তুই বলছিস সর্বোনাশ?’
চুপ করে গিয়েছিল যমুনা। সত্যিই তো, মানুষটা এত কিছু করে দিয়েছে তার জন্য। নিজের ভাইদের হাতে পায়ে ধরেও একটু মাথা গোঁজার ঠাঁইও সে পায় নি। আর এই অচিন মানুষটা-
যমুনার প্রতিবাদ শিথিল হয়ে আসতেই রাক্ষসের খিদে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মণ্ডল। আচমকা এক দমকা ঝড়ে উড়েই যায় বুঝি যমুনার ছোট্ট কুঁড়েঘরটা। তারপর একসময় থেমে গিয়েছিল ঝড়। মণ্ডল জামার পকেট থেকে একশ’ টাকার দু’খানি নোট যমুনার ব্লাউজের ফাঁকে গুঁজে দিয়ে বলেছিল, ‘এটা রাখ। আর শোন্্, কখনো কিছু লাগলে আমায় বলিস তবে হ্যাঁ, খবরদার কেউ যেন জানতে না পারে এই কথা। তাহলে-’
তাহলে যে কী হবে তা আর বলে নি মণ্ডল। টলমল পায়ে কুঁড়ে থেকে বেরিয়ে মিলিয়ে গিয়েছিল ভেড়িবাধের অখ- আঁধারে। ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল যমুনাও। তার সারা শরীর তীব্র দহনে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছিলো বারবার। ভেড়িবাঁধের খোলা হাওয়াতেও সে জ্বলন এতটুকু না কমলে অবশেষে জলে নেমে শরীরটাকে ঘষে ঘষে তুলে ফেলেছিল সেই দহন জ্বালা। একসময় সব আবার শান্ত হয়ে এলে উঠে এসেছিল জল থেকে।
তখন অবশ্য অনেক রাত। সারা ভেড়ি অঞ্চল জুড়ে বরফ জমাট নির্জনতা। সেই নির্জনতার ফাঁক গলে পূবের আকাশে উঠে এসেছে আধখানা চাঁদ। ফিনফিনে একটা জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে চারপাশে। জলের বুকে জ্বলে উঠেছে লক্ষ লক্ষ টুনি বাল¡। চিংড়ির চোখ ওগুলো। সারারাত এভাবেই চোখ মেলে জেগে থাকে ওরা। যেমন করে বাকি রাতটুকু জেগে ছিল যমুনা।
সেই শুরুর আর শেষ হয় নি। তারপর থেকে প্রতি রাতেই আসে মাধব মণ্ডল। যমুনার শরীরটাকে রাক্ষসের খিদে নিয়ে ছিঁড়ে খুঁড়ে খায়। খেতে খেতে নিজেকেই নিঃশেষ করে দেয় যমুনার শরীরে। তারপরে নিজের ক্লান্ত শরীরটাকে আঁধারের মধ্যে দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায় বাড়ির দিকে। কিন্তু যমুনার শরীরের জ্বলন তীব্র থেকে কেবল আরও তীব্র হয়। ভেড়ির জলে নেমে তবেই নেভাতে হয় সেই আগুন। তারপর সারারাত বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেবল এপাশ ওপাশ করে। এমন একটা জীবন থেকে মুক্তি পেতে ইচ্ছে হয়। আবার মণ্ডলকেও বাধা দিতে পারে না। পৃথিবীর সব আশ্রয় যখন যমুনার কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিল তখন এই মানুষটাই তাকে আশ্রয় দিয়েছে। দুই বেলা মুখে দু’মুঠো অন্ন তোলার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। নতুন একটা জীবন তাকে দিয়েছে। সেই মানুষটা যখন এতকিছু দিয়েছে তখন তাকেই বা খালি হাতে ফেরায় কী করে যমুনা।
যমুনা ভাবে। সারাটা রাত ধরেই ভাবে। ভেড়িবাঁধের অখ- নির্জনতায় যখন আড়াল হয়ে যায় চারপাশ, ঝিঁঝিঁর ডাক থেমে যায়, কেবল জলপোকাদের বিচিত্র স্বর ভেসে আসে আঁধারের পিঠে সওয়ারী হয়ে, দূর থেকে ভেসে আসে শেয়ালের ডাক, তখন হঠাৎ করেই যেন সামনে এসে দাঁড়ায় যমুনার স্বামী নাদুরাম। বলে, ‘আমারে ইভাবে ঠকালি যমনা?’
যমুনা বলে, ‘কী করবো কও? এ ছাড়া যে বাঁচার আর পথ নাই গো আমার।’
নাদুরাম বলে, ‘এরে বাঁচা কয়?’
‘নয় তো কী? তুমি তো আমারে ফ্যালাইয়ে গেছো একা। অহন আমি কই থায়ি? কী খাই?’
‘এত বড়ো দুনিয়ায় এ্যাত্তোটুকুন ঠাঁই পাবি নে?’
‘তা আর পালাম কই। যা দেছে তা তো এই মাধব মণ্ডল। তার জন্যিই তো আজও বেঁচ্যে আছি।’
যেমন হঠাৎ করে আসে তেমনি হঠাৎ করেই চলে যায় নাদুরাম। ভাঙা বেড়ার ফাঁক দিয়ে বয়ে আসা এক দমকা ভেজা হাওয়া ছুঁয়ে যায় যমুনাকে। ফের একবার উঠে পড়ে যমুনা। দরজার ঝাঁপ ঠেলে বাইরে এসে দাঁড়ায়। চরাচর জুড়ে ভেসে থাকা নোনা গন্ধ নাকে মুখে ঝাপটা মারে। পাড় থেকে ঝুপ করে লাফিয়ে পড়ে ব্যাঙ। কাছেই ডেকে ওঠে কোনো জলপোকা। অনেকখানি নিচে নেমে এসে ঝুলে থাকে আকাশটা।
এখনও এভাবেই দাঁড়িয়ে আছে যমুনা। তবে এখন রাত্রি নয়। দিন। আরও একটা বিকেল শেষের পথে হেঁটে চলেছে দ্রুত। চারপাশে কমে আসছে আলো। মেনি বেড়ালের মতো মিইয়ে গেছে রোদ। সামনের অসংখ্য ভেড়িবাধের গায়ে গায়ে দিন শেষের ইশারা।
আচমকা পিছনে পায়ের শব্দে ঘুরে তাকালো যমুনা। আর অমনি বিষ্টুপদর মুখোমুখি। যমুনার মতোই মাধব মণ্ডলের রাখা মুনিষ বিষ্টুপদ। সে ভেড়ি পাহারা দেয়। মাছেদের খাবার দেয়। আর একলা সময় কাটায়। ভেড়িবাধের টঙই তার ঘর। আর তার ছোট্ট সংসার। অবশ্য পাশের গাঁয়ে তার নিজের একটা বাড়ি আছে। ঘর আছে। উঠোন আছে। আর মাথার ওপর নিজের একফালি আকাশও আছে। মালতি যতদিন ছিল কত সুন্দর ছিল সংসারটা। আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকলেও সুখ ছিল। মন ভরা শান্তি ছিল। পাশের বাড়ির বীরেনের সঙ্গে যেদিন ঘর ছাড়ল মালতি সেদিন থেকেই সব সুখ চুরি হয়ে গেল যেন। আর নিজের বাড়িঘরটাও মনে মনে পর হয়ে গেল। এসে উঠল মাধব মণ্ডলের ভেড়িবাধে।
এসব বিষ্টুপদর কাছেই শুনেছে যমুনা। এক একটা সময় হাঁটতে হাঁটতে যমুনার ভাঙাচোরা কুঁড়েঘরটার সামনে এসে দাঁড়ায় বিষ্টুপদ। অনেক কথাই হয় যমুনার সঙ্গে তার। আবার কখনো যমুনা নিজেও যায় বিষ্টুপদর টঙঘরে। ধূ ধূ প্রান্তর জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গতার মাঝে একটু যেন শান্তি পায় দু’জনেই।
সেই বিষ্টুপদকে দেখে একটু বুঝি চমকেই উঠলো যমুনা। জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু ক’বা বিষ্টু দা?’
যমুনার চোখের দিকে তাকালো বিষ্টুপদ, ‘এই জেবন তোর ভালো লাগে যমনা?’
ফের ঘুরে গিয়ে ভেড়ির জলে চোখ রাখল যমুনা। সেখানে এখন দিনান্তের ইশারা মাখা আকাশের ছায়া। সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘না গো।‘
‘তোর নতুন কইরে ঘর বাঁধতি ইচ্ছে হয় না? নতুন ঘর। নতুন সোংসার।’
‘সে তো হয়ই বিষ্টু দা। কিন্তুক কেডা আর আমারে সেই ঘর দেবে? সেই সোংসার দেবে?’
‘যদি আমি দেই?’
‘কী কও তুমি বিষ্টু দা?’
‘হ রে,ঠিকই কই। আমি জানি নিত্যি রাইতে মণ্ডল তোর ঘরে আসে। তারপরেও আমি তোরে বে’ করতি চাই যমনা। আমার সোংসারডারে নতুন কইরে সাজাতি চাই। তুই ভেব্যে দ্যাখ – নতুন ঘর। নতুন সোংসার। নতুন ভালোবাসা।’
‘তুমি আমারে ভালোবাসো বিষ্টু দা?’
‘হ রে।’
যমুনা ঘুরে মুখোমুখি হল বিষ্টুপদর, ‘এ তুমি কী স্বপন দেহালে আমারে বিষ্টু দা?’
‘ঝপ করে যমুনার হাতটা ধরে ফেলল বিষ্টুপদ, ‘স্বপন নারে যমনা, সত্যি। সত্যি কইরে সোংসারডা গড়তি চাই। ভাঙা মনডারে জোড়া লাগাতি চাই। তুই যদি রাজি থাকিস তাহলি আজই-’
আকাশের দিকে তাকাল যমুনা। দিনান্তের ইশারা গায়ে মেখে সব রোদ শুষে নিচ্ছে আকাশ। একটু পরেই চরাচর ঘিরে যাওয়া আঁধারে গা ঢাকবে সেও। তবুও তার সারা গায়ে ফুটে থাকবে অসংখ্য তারা। লক্ষ কোটি আলোর বিন্দু। সূর্যের ঝকমকি নয়, চাঁদের জ্যোৎস্না নয়, ক্ষুদ্র ওই বিন্দু আলোতেই বেশ চলে যাবে যমুনার।
বিষ্টুপদর কথার উত্তর দিতে ভুলে গেল যমুনা। তার দু’টো চোখ এখন ওই ক্ষুদ্র আলোতেই স্বপ্ন দেখতে ব্যস্ত।
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত থেকে।