জুলাই মাস। বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ তৈরি হয়েছে। গতকাল সকাল থেকেই প্রবল বৃষ্টির ধারা। মহা তাণ্ডবের শব্দে বেজে যাচ্ছে বজ্রপাত। আবহাওয়া অফিস বলেছে পাঁচ দিন চলবে এই তাণ্ডবময় ঝমঝম অবস্থা। বারান্দায় বসা যায় নি, বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিল। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে বাইরেটা দেখব সে উপায় নেই। বজ্রপাতের সময় লোহার সংস্পর্শে না আসতে টেলিভিশনে সর্তক বার্তা দেয়া হচ্ছে। কি করব ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। গান শোনা আর লেখালেখি। কিন্তু কতক্ষণ! কয়দিন! খোলা আকাশের জন্য হাহাকার লাগছে।
মেয়েবেলার কথা মনে পড়ছে, ঠিক এমনি আকাশের দশা চলেছিল টানা চারদিন। হমম, টানা চারদিন ছিল আমার বন্দিদশা। সে ক’দিন আব্বা স্কুলে যেতে দেন নি। উপরি দশা হিসেবে ছিল সারাদিন ইংরেজিতে কথা বলতে হবে। বাংলা কোনো শব্দ গ্রহণযোগ্য না। ইংরেজি শিখতে হবে। এছাড়া নাকি ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আমার খুব মনে পড়ে চার দেয়ালে বন্দি হয়ে টানা চারদিন বিবিসি শুনতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করা আর বাংলা ভাষা চর্চার জন্য আমরা ক’বন্ধু মিলে একটা সংগঠন করেছিলাম। ওই সময়টায় যখন মাথা ভর্তি বাংলা চর্চা ঘুরঘুর করছিল সেখানে ঘরে বসে শিখতে হচ্ছে ইংরেজি! মানতে পারি নি আমি। মানতে পারে নি আমার বন্ধুরাও। বসার ঘর থেকে আব্বা একটু সরলেই ল্যান্ডফোন থেকে ফিসফিসিয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলতাম। পাছে আবার আব্বার কানে পৌঁছয়। আব্বার ওপর ভীষণ অভিমান হয়েছিল, রাগ গিয়ে পড়েছিল বৃষ্টির ঘাড়ে। আজও রাগ হয় কোনো বন্দিদশায় পড়লে। ছটফট করে ওঠে মন। আমার মেয়েবেলার স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল। পাড়ার বন্ধুরা মিলে স্কুলে যাব, বিকেলে খেলতে বের হবো, মায়ের ভাষায় যা মন চায় বলব এমনি কিছু সাধারণ সেই চাওয়াতেই ছিল আমার অসাধারণ স্বাধীনতা।
বৃষ্টির আজ তৃতীয় দিন। বের হতে পারি নি আজও। বই পড়ে আর এফএম রেডিওতে গান, খবর, কথাবার্তা শুনে সময় কাটছে। হঠাৎ একটা গানে কান আটকে গেল, ‘তিরিশ বছর পরেও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি’। ইউটিউবে আবার শুনলাম। বলে কি! স্বাধীনতাটাকে খুঁজছে! কেন! আমার শহীদ মিনার, আমার পতাকা, কোথায় এসব! এ কি হারাবার জিনিস! বৃষ্টির এই বন্দিদশায় ভীষণ অস্থির হয়ে পড়লাম। ভালো লাগছিল না কিছুই। পেছনে চলে গেল মনটা।
ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালে রক্ত হিম হয়ে আসে। কেমন ছিল ১৯৭১ এর আগের সময়গুলো! কেমন কাটত প্রতিটি ক্ষণ! নিজ ভূমিতে পরবাসী ছিল যে মানুষগুলো! স্বাধীনতাপূর্বের স্বাধীনতাকামী কোনো মানুষকে যদি জিজ্ঞেস করি কি পেলেন? একটাই উত্তর ‘এই যে প্রশ্ন করতে পারছ, এটাই’। ওই দিনগুলোতে কতখানি বন্দিদশা, কি ধরণের নির্মমতা থাকলে তাদের অনুভবে স্বাধীনতার মানেটা এমন দাঁড়ায়! তাই তো- চলাফেরার অধিকার নেই, বলার অধিকার নেই, প্রশ্ন উদ্রেকের কোনো সুযোগ নেই! কেমন করে বেঁচেছিলেন তারা! তাই তো তাদের কাছে স্বাধীনতার মানেটা এত সরল, এতটা আশাব্যঞ্জক। এফএম বোধহয় টের পেল আমার ভাবনা। গান চলছে ‘তুমি খুঁজে যাও কতখানে/ স্বাধীনতার কি মানে/ বলি একটা অন্ধ পাখি…/ আহা সেও তো সে কথা জানে’। কি দারুণ! কি দারুণ! আনন্দে উথলে ওঠে মন। এ তো আমারই কথা! সায়ানের কণ্ঠে বাজছে। কোনোদিন খাঁচায় পাখি পোষার শখ হয় না আমার।
ভেতর থেকে হাহাকার করে ওঠে, ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’। বন্দি পাখিটারে মুক্ত করে দিলে আনন্দে উচ্ছাসে দিগি¦দিক হয়ে ছুটতে যায়, আছড়ে পড়ে, আবার উঠে ভোঁওওও উড়াল। তিনদিন পর বৃষ্টি ধরে এলে ছাতাটা নিয়ে বের হলাম। আহ! কি শান্তি!
আমার মাথায় তখন তৃপ্ত স্বাধীনতা ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বাধীনতা আমার কাছে মুক্তিদশা। যে মুক্তিদশায় আমি আমার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের জোগান নিজে করব। যেখানে বাধা আসবে গলা উঠাব। নিজের অধিকার, নিজের কর্তব্যজ্ঞান নিজে ঠিক করব। আমার জন্য সাজানো গোছানো দেশটা ওই শহীদ মিনার কিংবা ওই পতাকা এনে দেবে না। ‘স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা করা নয়’Ñ কথাটির সাথে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই একমত হবেন। একজন বা একটা দলের যা খুশি তা করা স্বাভাবিকভাবেই স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। স্বেচ্ছাচারিতা এমন এক আচরণ যা শুধু নিজেকে নিয়েই ভাবতে শেখায়, কর্মেও শুধু নিজের ভাবনারই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। নিজ কর্তব্যজ্ঞানে স্বেচ্ছাচারিতার কোনো স্থান নেই। মুক্তিদশাকে টিকিয়ে রাখার প্রতিচ্ছবিটাও যেন থাকে আমার ভাবনায়, থাকে আমার কর্মে। আমার বাংলা ভাষা মুক্তি পাওয়ার সত্তর বছর পেরিয়েছে। আর স্বাধীনতার পার করেছি পঞ্চাশ বছর। শুধু নিজ নিজ কর্তব্যজ্ঞানের হেলাতে হারাতে বসেছি স্বাধীনতার মূল চার মন্ত্র। আর ভালোবাসার অভাবে হারাতে বসেছি পুরো স্বাধীনতাটাই। পৃথিবীর একমাত্র দেশ বোধহয় এই একটিই যেখানে এখনো কিছু নাগরিক স্বাধীনতার বিপক্ষে কথা বলেন, প্রশ্ন তোলেন স্বাধীনতার নেতাকে নিয়ে, শখ করেন বন্দিদশার। তো সে দেশের মুক্তদশার চিত্র অভ্যন্তরীণভাবে চিত্রায়িত করা এত সহজ কাজ না। আর সে কারণেই উত্তর আফ্রিকার ছোট্ট দেশ তিউনিসিয়ার উচ্চশিক্ষিত বেকার যুবক মোহাম্মদ বুয়াজিজির নিজ গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া আর আমার দেশের ইলিয়াস মিয়া ও শওকত আলীর মোটর বাইকে আগুন ধরানোকে সমান্তরালে ফেলা যায় নি।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত লক্ষ-কোটি হতাশ যুবকের প্রতীক হিসেবে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন বুয়াজিজি। তিউনিসিয়ার বেকার যুবক উপায়ন্তর না পেয়ে তরকারি ফেরি করে চলছিল। পথে ফেরি করার অপরাধে পুলিশকে একাধিকবার ঘুষ ও জরিমানা দিতে হয়েছিল। ঘুষ, জরিমানার সাথে যখন শারীরিকভাবেও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল তখন বুয়াজিজি নিজ গায়ে আগুন লাগিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিল। পুরো মধ্যপ্রাচ্য থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত সেই আগুন ছড়িয়ে তৈরি করেছিল গণজাগরণ। পশ্চিমা গণমাধ্যম এর নাম দিয়েছে ‘আরব বসন্ত’। বসন্তের বাতাস লেগে যায় মিশর, লিবিয়া, সিরিয়ায়। কতখানি সুমিষ্ট বসন্তের বাতাস এই দেশগুলোতে লেগেছে তা প্রশ্নবিদ্ধ। আবার আমার দেশের জাগরণ বৃথা যায় নি একটিও। এটা গর্বের। ভাষা পেয়েছি, দেশ পেয়েছি, দেশের চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরোধীদের শাস্তি পেতে দেখেছি। সমস্যা রয়ে গেছে অচিহ্নিতদের নিয়ে যারা মিশে আছে স্বাধীনতা পক্ষের মানুষেদের সাথে, রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল পদে। শুধু দেশের প্রতি, দেশের মানুষদের প্রতি ভালোবাসার জন্য যেখানে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এত এত অর্জন সেখানে আজও প্রশ্নবিদ্ধ স্বাধীনতার মূলমন্ত্র। আমার দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আলোচনার টেবিলে আসে নি, এসেছে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। গেল পঞ্চাশ বছরে অর্থনৈতিক ও সামাজিক তথা শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, যোগাযোগ, শিল্প, কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চোখ ধাঁধানো অর্জন অনেক। আমাদের সাফল্যও আছে।
মানবস¤পদ উন্নয়ন সূচকেও অনেক উন্নয়নশীল দেশের চেয়ে আমরা এগিয়ে আছি। তা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের মূলনীতিসমূহ প্রশ্নবিদ্ধ। অন্তঃসারশূন্য চোখ ধাঁধানো বলেই এমনটি হয়েছে। তাই বলে কি আমার মুক্তদশা প্রশ্নবিদ্ধ হবে!
আমাদের রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি চারটি- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় চারটি বিষয়ই সার্বভৌমত্ব অর্জনের পরের ধাপ। ঘাটতি আছে সর্বস্তরে মূলনীতি প্রতিষ্ঠায়। রাষ্ট্র থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে অবহেলার ছাপ রয়েছে সবখানেই। আমরা অকৃতজ্ঞের মতো যেমন অস্বীকার করছি আমাদের সার্বভৌমত্বকে, তেমনি লোভের বশবর্তী হয়ে পেট ভরছি শুধুই নিজের। আমরা শখ করে যেমন ভুলতে বসেছি আমাদের শাড়ি-লুঙ্গিকে তেমনি সচেতনভাবেই উৎখাতে ব্যস্ত অন্য ধর্মাবলম্বীদের। তাই দায় আমাদেরই। আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমরা সচেতন হয়ে গণজোয়ার দিয়ে লড়াই করে সার্বভৌমত্ব পেয়েছি, আমাদের মুক্তদশা এসেছে। ’৭১-এ স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত সময়টারও দিক ঘোরাতে হয়েছে গণজোয়ার দিয়েই। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েই ঘাটতি পূরণ করতে হবে আমাদের মূলনীতি সমূহের। সচেতন হতে হবে, এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরই।
যেখানে নির্দ্ধিধায় সমোচ্চারিতভাবে সকলের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হবে – ‘স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা’।
কত শত মুক্তির ভাবনায় বৃষ্টি ধরে এসেছে। বাইরে বেরুলাম। আহ্্ প্রশান্তি! আমার খোলা আকাশ! ভাবছি আবার একটা সংগঠন করব। সে সংগঠনটি কাজ করবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করতে আর বাংলা ভাষা চর্চায়। স্বাধীনতাকে খুঁজতে হবে- এ কথাটি যেন মনে আর না আসে। শুধু যেন মনে হয় একটা সাজানো দেশ গড়তে হবে আমাকেই, আমাদেরকেই।
লেখক: শিক্ষাবিদ।